খবর৭১ঃ আগামী বছর নাগাদ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। তবে এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে ২০২৪ সালে। ঐ বছর থেকেই ইউরোপ বাদে বিশ্বের বাকি দেশগুলোতে বাংলাদেশি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকছে না। ঐ ধাক্কা সামলানোর লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বা আঞ্চলিক ভিত্তিতে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট-এফটিএ), অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করার বিষয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে ১০টির বেশি দেশের সঙ্গে আলোচনা চলমান। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগামী তিন থেকে চার বছরে অন্তত ১৫টি দেশের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি হবে। এ ধরনের চুক্তি হলে বাংলাদেশি পণ্য ঐসব দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। অন্যদিকে ঐ দেশগুলোকেও বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে হবে। আর এতেই আপত্তি জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কেননা এফটিএ বা পিটিএ হলে শুল্ক খাতে রাজস্ব আদায় কমে যাবে।
সম্প্রতি এনবিআর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এক চিঠিতে যে কোনো দেশের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তির ক্ষেত্রে রাজস্ব লোকসান এবং স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রাখার অনুরোধ জানিয়েছে। বিশেষত যেসব দেশে বাংলাদেশের রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি ঐসব দেশ, বিশেষত ভারত, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশের সঙ্গে চুক্তি না করার পক্ষে এনবিআর। এসব দেশের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি হলে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি বাণিজ্য ব্যবধান (আমদানি-রপ্তানির পার্থক্য) আরো বেড়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা এনবিআরের।
অবশ্য রাজস্ব আদায়ে কিছুটা ক্ষতি হলেও দেশের ভবিষ্যত্ রপ্তানি বাজার সুরক্ষায় এফটিএ ও পিটিএর মতো চুক্তির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, বাস্তবতা বিবেচনায় আমাদের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এখন জরুরি হয়ে গেছে। এটি আমাদের করতেই হবে। প্রধানমন্ত্রীও এফটিএ, পিটিএ করার পক্ষে। তিনি বলেন, এখনই কাজ শুরু করা দরকার। না হলে ২০২৪ সালের পর চাপ বেড়ে যাবে। আগামী তিন বছরে ১৫ থেকে ২০টি দেশের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটানের সঙ্গে এফটিএর বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। আগামী মাসের শুরুতে এ চুক্তি করতে যাচ্ছে সরকার। এর বাইরে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে এফটিএর বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। আরো আট থেকে ১০টি দেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে। কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্টের (সিইপিএ) আওতায় প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গেও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা চলছে। অন্যদিকে কিছু আঞ্চলিক চুক্তির সঙ্গেও যুক্ত হতে চাইছে বাংলাদেশ, যাতে ঐসব অঞ্চলের দেশগুলোতে রপ্তানিতে শুক্তমুক্ত সুবিধা পাওয়া যায়।
অর্থনীতিবিদরাও মনে করছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বাংলাদেশকে এফটিএ, পিটিএর মতো চুক্তিতে যেতে হবে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ইত্তেফাককে বলেন, রাজস্বের অংশ হিসেবে শুল্কের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশও তাই করছে। তাদেরও একসময় অনেক প্রতিরক্ষণ (বেশি হারে শুল্ক) ছিল। কিন্তু এখন দুই-তিন শতাংশে নামিয়ে এনেছে। ভিয়েতনামও তাই করেছে। আমাদের এফটিএ, পিটিএতে যেতেই হবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর বাণিজ্যিক জোট আসিয়ানের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ঐসব দেশে গড় ট্যারিফ (শুল্ককর) হার ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ আমাদের দেশে তা ২৬ শতাংশের বেশি। এত বেশি শুল্কের দেশের সঙ্গে তারা কেন বাণিজ্য করতে আসবে?
জানা গেছে, বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট (বিএফটিআই) এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ২০২৪ সালে সম্ভাব্য ধাক্কা সামলাতে এ ধরনের চুক্তি করার বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল। বিএফটিআইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলী আহমেদ ইত্তেফাককে বলেন, যে কোনো দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক চুক্তির বিষয়ে আলোচনা শুরু হলেই সঙ্গে সঙ্গেই তো তা বাস্তবায়ন হয় না। আমাদের এই আলোচনা আরো আগে থেকেই হওয়া দরকার ছিল। তাও মন্দের ভালো, এখন এ বিষয়ে অগ্রগতি হচ্ছে।
এনবিআরের হিসাবে, সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ লাখ ২৩ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এর মধ্যে কেবল শুল্ক আদায় হয়েছিল ৬৩ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। এছাড়া আমদানি পণ্যে আগাম কর (এটি) ও অগ্রিম আয়কর (এআইটি) বাবদ কর্তিত অর্থ মিলিয়ে মোট রাজস্বের ৩০ শতাংশের বেশি আদায় হয় এ খাত থেকে। দ্বিপাক্ষিক হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য চীন ও ভারতের সঙ্গে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে ১০৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি বিপরীতে আমদানি করেছে ৯২১ কোটি ডলারের। বাণিজ্য ব্যবধান ৮১৭ কোটি ডলার। একই সময়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ব্যবধান ১ হাজার ২৮০ কোটি ডলারের। একইভাবে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের সঙ্গেও বাংলাদেশের বড় বাণিজ্য ব্যবধান রয়েছে। আমদানি পর্যায়ে আদায়কৃত রাজস্বের বেশির ভাগই এসব দেশ থেকে আসে। এ কারণে এনবিআর রাজস্ব আদায়ের বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখার অনুরোধ জানিয়েছে। এসব দেশের বাইরে বরং ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা যায় বলে মত দিয়েছে