খবর৭১ঃ মানবদেহে ব্যবহারের জন্য নিরাপদ এবং সফলভাবে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সক্ষম এমন টিকা আবিষ্কারের ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সারা বিশ্ব। অনেকগুলো কোম্পানি তাদের টিকা মানবদেহে পরীক্ষামূলক ব্যবহারের পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই লাখ লাখ ডোজ টিকার জন্য অগ্রিম চুক্তি করে রেখেছে বেশ কিছু পশ্চিমা দেশ। যেমন শুধু যুক্তরাজ্য একাই ৩৪ কোটি ডোজ টিকার নেবার চুক্তি করেছে বেশ কয়েকটি ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির সাথে।
বাংলাদেশও টিকা প্রস্তুতকারী দেশগুলোর সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ বজায় রাখা এবং টিকা কিনে আনার জন্য প্রস্তুত বলে সরকার জানিয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের টিকা বণ্টনের ক্ষেত্রে কারা অগ্রাধিকার পাবেন সে ব্যাপারে একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে।
কারা প্রথম টিকা পাবেন, কীভাবে তা বণ্টন করা হবে?
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, একটি সফল টিকার প্রয়োগ শুরু হলে এবং বাংলাদেশ সেটি পেলে চিকিৎসক, সেনাবাহিনীর সদস্য, বয়স্ক ব্যক্তি, সাংবাদিক এবং স্কুল শিক্ষকেরা অগ্রাধিকার পাবেন। রবিবার সচিবালয়ে এক কর্মশালায় তিনি সাংবাদিকদের একথা বলেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেছেন, ‘একটা ফ্লো চার্ট আমরা তৈরি করেছি। কীভাবে টিকা যোগাড় করা হবে, কীভাবে সেটি দেয়া হবে এরকম একটি খসড়া কর্মকৌশল প্রস্তুত করা হয়েছে। দুই তিন দিনের মধ্যে সেটি চূড়ান্ত করা হবে।’
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে সরকারের গঠিত একটি কারিগরি কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বিস্তারিত একটি কর্মকৌশলের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।
এই কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন জানিয়েছেন, ‘ভ্যাকসিন এলে কীভাবে তা সংরক্ষণ করা হবে, কীভাবে বণ্টন করা হবে, অগ্রাধিকার কারা পাবেন, তাদের কীভাবে নির্বাচন করা হবে, তাদের সাথে কীভাবে যোগাযোগ করা হবে, আর্থিক ব্যাপারসহ এরকম অনেকগুলো বিষয় নিয়ে খসড়াটি তৈরি হয়েছে।’
কারা অগ্রাধিকার পাবেন
খসড়াটির কিছু ধারণা পাওয়া গেছে কমিটির কয়েকজন সদস্যের সাথে কথা বলে। তারা তাদের নাম প্রকাশ করতে চাননি। বিবিসিকে তারা বলছেন, তিন ধরনের ব্যক্তি অগ্রাধিকার পাবেন।
প্রথম ধাপে রয়েছেন করোনাভাইরাস মোকাবেলায় একেবারে সম্মুখ সারিতে কাজ করছেন এমন ব্যক্তি।
যেমন চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। দ্বিতীয় ধাপে অগ্রাধিকার পাবেন ‘কো-মরবিডিটি’ রয়েছে এমন ৬৫ বছরের বেশি বয়সের ব্যক্তি।
অর্থাৎ কিডনি, হৃদযন্ত্রের সমস্যা ইত্যাদি নানা জটিল অসুখে ভুগছেন এমন ব্যক্তি যাদের করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
তৃতীয় ধাপে থাকবেন ৬৫ বছরের বেশি যাদের বয়স তারা। এরপর টিকার ডোজের পরিমাণ বিবেচনা করে বাকিদের কথা বিবেচনা করা হবে।
বিনামূল্যে যারা পাবেন
এই তিন ধরনের ব্যক্তি সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে এই টিকা পাবেন।
তবে এর বাইরে যারা রয়েছেন তাদের কি টিকা কিনতে হবে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেবার পর বেসরকারি খাতে টিকা বিক্রির সুযোগ থাকবে কি না, বেসরকারি খাতের কোম্পানিগুলো নিজেরা টিকা আনবে কি না – সেসব বিষয়ে এখনো পরিষ্কার জানা যায়নি।
কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, সরকার আশা করছে শুরুতে তিন কোটি টিকা পাওয়া যাবে।
এর আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, যে ভ্যাকসিনটি কম দামে দ্রুত পাওয়া যাবে সেটির ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ বেশি এবং সেজন্য মূলত পাঁচটি দেশের সাথে সরকার বেশি যোগাযোগ করছে।
যেভাবে অগ্রাধিকার যাচাই ও টিকা দেয়া হবে
বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচির বেশ সুনাম রয়েছে। সেসব কর্মসূচির মতো করেই করোনাভাইরাসের টিকা দেবার চিন্তা রয়েছে সরকারের। বিভিন্ন জেলায় টিকাদান কেন্দ্র তৈরি করে সেগুলো দেয়া হবে।
যাদের কো-মরবিডিটি রয়েছে এরকম ৬৫ বছর বয়সের ঊর্ধ্বের ব্যক্তিদের সম্পর্কে হাসপাতাল থেকে তথ্য নেয়া হতে পারে, তারা নিজেরাও যোগাযোগ করতে পারেন, বিশেষ করে যারা প্রথম ধাপের অগ্রাধিকার প্রাপ্ত ব্যক্তি। তবে এই বিষয়টিও পুরোপুরি চূড়ান্ত নয়।
টিকার কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ
তবে বয়স্কদের শরীরে এই টিকা কতটা কার্যকর হবে সে নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছেন বিশ্বের অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
করোনাভাইরাস বিষয়ে সরকারের করা একটি ক্লিনিকাল ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য ডা. এম এ ফায়েজ বলছেন, ‘করোনাভাইরাসের টিকা বড়দের টিকা। এর কটি ডোজ হবে, প্রথম ডোজ পাওয়ার পর আরও ডোজ দরকার হবে কি না এসব কিছুই সুনির্দিষ্ট নয়।’
তার মতে, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এগুলোর একটি ফলোআপ দরকার হবে। কারণ ভ্যাকসিনের সফলতা কতটুকু, শরীরে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে কি না, শরীরে অ্যান্টিবডি কতটা তৈরি হলো- এসব দীর্ঘ মেয়াদে পর্যবেক্ষণের বিষয় রয়েছে।’
তবে তিনি বলছেন, ‘কিছু টিকা এনে সেটি প্রয়োগ করলেই ধরে নেয়া উচিত হবে না যে জীবন আগের পর্যায়ে ফিরে গেছে। জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধের যেসব পদ্ধতি রয়েছে টিকা হচ্ছে তার একটি অংশ। একমাত্র পন্থা বা প্রধান পন্থাও নয়। অনেক রোগ আছে যার ভ্যাকসিন আছে কিন্তু তবুও রোগটি পৃথিবীতে রয়েছে।’
তিনি বলছেন, করোনাভাইরাসে যেহেতু বয়স্করা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন, তাদের জন্য এই টিকা উপকারী হতে হবে।
‘কিন্তু তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। তাই আদৌ টিকা কার্যকর হচ্ছে কি না, তাদের টিকা দেয়ার পর কী ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে এসব কিছুর দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণ দরকার হবে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাছাড়া বাঙালিদের জিন শারীরিক গঠনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’
তবে সরকারের কর্মকৌশল যেহেতু এখনো খসড়া পর্যায়ে রয়েছে তাই এসবের কোনো কিছুই চূড়ান্ত নয়। –