ঝিনাইদহের গাছিরা খেজুর গাছ তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছে

0
451
ঝিনাইদহের গাছিরা খেজুর গাছ তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছে

রাব্বুল ইসলাম, ঝিনাইদহ প্রতিনিধিঃ শীতের আগমনের সাথে সাথে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুর রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছে ঝিনাইদহের বিভিন্ন গ্রাম অঞ্চলের গাছিরা। গ্রামের পরিত্যাক্ত জায়গা ও আকা-বাকা পথের পাশে ডোবা-পুকুর পাড়ে সারি সারি অপরিচ্ছিন্ন খেজুর গাছ গুলোর পুরানো ডাল পালা কেটে পরিষ্কারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং অনেক গাছের পরিচর্যা চলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূল এলাকার মৌসুম গুলি কিছু দেরিতে শুরু হয়।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলা সহ বেশ কয়েকটি উপজেলা ঘুরে সরেজমিনে দেখা গেছে শীতের তীব্রতা দেখা না দিলেও এরই মধ্যে অনেক গাছি খেজুর রস সংগ্রহের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। গ্রামীণ জীবনে শীত এ অঞ্চলের গাছিদের কাছে বিভিন্ন মাত্রায় রূপ নিয়ে আসে। নানা স্বপ্ন আর প্রত্যাশায় তাদের অনেকটা সময় কেটে যায় এই খেজুর গাছের সাথে। সারাদিন এক গাছ থেকে অন্য গাছ এভাবেই তাদের দিন কেটে যায়। গাছির জীবন সংগ্রামে বহু কষ্টের মাঝে অনেক প্রাপ্তিই মিটে যায় গ্রাম বাংলার এই জনপ্রিয় বৃক্ষ খেজুর রস আহরণের সাথে। গাছিদের কাছে এই সময়টা হয় অনেক আনন্দের। গাছ কাটার জন্য গাছের মাথার এক দিকের ডাল কেটে পরিষ্কার করা হয়। আর কাটা অংশের ঠিক মাঝ বরাবর নিচে দুটি ভাজ কাটা হয়। সে ভাজ থেকে কয়েক ইঞ্চি নিচে একটি সরু পথ বের করা হয়। এই সরু পথের নিচে বাঁশের তৈরি নালা বসানো হয়।

এই নালা বেয়ে চুয়ে চুয়ে পাত্রে রস পড়ে। সাধারণত দুপুরে গাছে ভাড় বেঁধে রাখা হয়, সারা রাতে রস পাত্রে পড়তে থাকে। এসময় শালিক, দোয়েলসহ বিভিন্ন ধরনের পাখিরা গাছে ভিড় করে রস খাওয়ার জন্য। গাছ কাটার পর দুই দিন রস পাওয়া যায়। প্রথম দিনের রস পাটালি গুড় তৈরী হয়, আর দ্বিতীয় দিনের রসে ঝোলা গুড় তৈরী হয়। রসের জন্য খেজুর গাছে একবার কাটার পর পাঁচ-ছয় দিন পর কাটা হয়। গাছের কাটা অংশ শুকানোর জন্য এসময় দেওয়া প্রয়োজন। খেজুর গাছ কাটা অংশ শুকানোর সুবিধার জন্যই সাধারণত পূর্ব ও পশ্চিম দিকে গাছ কাটা হয়। যাতে সূর্যের আলো সরাসরি কাটা অংশে পড়ে। ভোরের হাড় কাপানো ঠান্ডায় গাছ থেকে রসের পাত্র নামিয়ে হিমশীতল খেজুর রস খাওয়ার স্বাদটাই মধুর। ভোর বেলায় রস খেলে শীত মনে হয় আরো বেশি জেকে বসে। শীত লাগে লাগুক তবুও রস খাওয়ার চাই। যতই শীত লাগুক না কেনো রস খেতেই হবে।

তারপর রোদ পোহানো আনন্দের অনুভূতি অন্যরকম। ভোরে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা রোদ পোহানোর সাথে অপেক্ষায় থাকে কখন গাছ থেকে নামানো হবে খেজুরের সু-মিষ্টি রস। খেজুর গাছ প্রায় ছয়/সাত বছর বয়স থেকে রস সংগ্রহ করা যায়, আর পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত গাছ থেকে রস পাওয়া যায়। তবে গাছ যতই পুরনো হয় রস দেয়া ততই কমে যায়। পুরনো গাছ রস কম দিলেও পুরনো গাছের রসগুলো খুবই মিষ্টি ও সুস্বাদু হয়। মাঝ বয়সের গাছ থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ রস পাওয়া যায়। বেশি রস সংগ্রহ করা গাছের জন্য অবার অনেক ক্ষতিকর।

তবে তারা জানায়, নতুন করে তেমন কেউ গাছির কাজ করতে আগ্রহী না হওয়ায় অনেক খেজুর গাছ পরিত্যাক্ত থেকে যাচ্ছে। সে জন্য সব গাছ থেকে রস বের করা সম্ভব হচ্ছে না। গাছিরা দিনের বেশির ভাগ সময় কাটান খেজুর গাছে। যেন মাটিতে পা ফেলার ফুসরত নেই। শীত আসা মাত্রই খেজুর গাছ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তোলার জন্য অনেক আগে থেকেই সকাল-সন্ধ্যায় যেন লেগে থাকে গাছিরা। খেজুর গাছ বিশেষ কায়দায় কাটতে হয়। গাছিরা বিভিন্ন উপকরণের সমন্বয়ে খেজুর গাছ পরিচ্ছন্ন ভাবে কাটার জন্য ব্যস্ত থাকেন। তারা গাছ কাটতে ব্যবহার করেন লোহা তৈরি ধারালো দা, মোটা দড়ি, দা রাখার জন্য বাঁশ বা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি থলি। যা গাছির কমড়ে রশি দিয়ে বেধে গাছে উঠা নামা করে।

গাছ কাটার জন্য গাছি শরীরের ভারসাম্য রক্ষার জন্য কোমর বরাবর গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে নেয়। দড়িটা বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়। এই দড়ির দুই মাথায় বিশেষ কায়দায় গিট দেওয়া থাকে। গাছে উঠার পর অতি সহজে গিট দুটি জুড়ে দিতে হয়। অনেকে আবার গাছের মাথায় দাড়ানোর জন্য শক্ত কাঠ বা বাঁশ রশি দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে দেয়। এতে গাছি নিরাপদে গাছ কাটাতে পারে। রস নামানোর পর জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। যা পাটালি গুড় ও ঝোলা গুড় বলা হয়। এ সব গুড় বিভিন্ন ভাবে খাওয়া হয়। শীতে খেজুর গাছের রস হতে যে গুড়ে তৈরি করা হয় তা দিয়ে দুধের পিঠা, পায়েস পুলি পিঠা তৈরি করে খাওয়ায়। তবে খেজুরের রস দিয়ে তৈরি রসের পিঠা খুবই সুস্বাদু হয়ে থাকে।

আর খেজুর গুড়ের সন্দেশের স্বাদ হয় অপূর্ব। বলতে গেলে একবার খেলে স্বাদ সারাজীবন যেন মুখে লেগে থাকে। গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য সাধারণত মাটির হাড়ি ব্যবহার করা হয়। এলাকা ভিত্তিক অনেকে ভাঁড় বলে। গুড় তৈরির জন্য রস জ্বাল দেওয়া হয় মাটির জালায় বা টিনের তাপালে। খুব সকালে রস নামিয়ে এনেই জ্বালানো হয়। জ্বাল দিতে দিতে এক সময় রস ঘন হয়ে গুড়ে পরিণত হয়। এ গুড়ের কিছু অংশ মাটির পাত্রে এক পাশে নিয়ে বিশেষ ভাবে তৈরি একটি খেজুর ডাল দিয়ে ঘষতে হয়। ঘষতে ঘষতে এই অংশটুকু শক্ত হয়ে যায়।

আর শক্ত অংশকেই আবার কেউ কেউ বীজ বলে থাকে। বীজের সঙ্গে মাটির পাত্রের বাকি গুড় মিশিয়ে দিলে গুড় জমাট বাঁধতে শুরু করে। তখন এ গুড় মাটির হাঁড়ি বা বিভিন্ন পাত্রে রাখা হয়। এ সময় গ্রামের বাজার গুলোতেও জমজমাট হয়ে ওঠে খেজুর রস এবং গুড়ে হাট। খেজুর গুড় কমবেশি বাংলাদেশের সব জায়গায় পাওয়া যায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here