খবর৭১; ঢাকায় প্রতিদিন ১৭৫ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩৫ কোটি লিটার শোধন করতে পারে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ঢাকা ওয়াসা। বাকি ১২০ কোটি লিটার ঢাকা ও চার পাশের নদী, খাল এবং জলাশয়ে মিশে পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মকভাবে দূষণ করছে। দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে পুরো ঢাকা মহানগর। চর্ম ও ফুসফুসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন নগরবাসী।
ওয়াসার সংশ্লিষ্টদের চরম গাফিলতিতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, পয়ঃবর্জ্য নিয়ে বিদ্যমান সমস্যা চলছে কয়েক যুগ ধরে। কিন্তু অদ্যাবধি নেয়া হয়নি তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। অথচ পানির বিলের সঙ্গে পয়ঃবর্জ্য নামে আরেকটি বিল আছে অনেক এলাকায়। সেখানকার গ্রাহকদের কাছ থেকে বিগত বছরগুলোতে গড়ে ২০০ কোটি টাকা আদায় করেছে সংস্থাটি।
এর মধ্যে চলতি অর্থবছরে পানি ও পয়ঃবর্জ্য বিল একত্রে বাড়িয়েছে ২৫ শতাংশ। সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরে ৩২৮ কোটি টাকা পয়ঃবর্জ্য বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা হবে। এত টাকা যায় কোথায়- এমন প্রশ্ন করে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ঢাকা ওয়াসার প্রধান কাজ হলেও বরাবরই প্রতিষ্ঠানটির পয়ঃনিষ্কাশন কাজে আগ্রহ কম। ফলে ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা ওয়াসা নগরবাসীকে চাহিদার আলোকে পানি সরবরাহ করতে সক্ষম হলেও পয়ঃনিষ্কাশন সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। কবে নাগাদ ঢাকাবাসীর পয়ঃনিষ্কাশন সেবা নিশ্চিত হবে- সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
আরও জানা গেছে, ঢাকা ওয়াসা নগরবাসীকে দৈনিক ২৫০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে। আন্তর্জাতিক হিসাব অনুযায়ী সরবরাহকৃত পানির ৭০ ভাগ পয়ঃবর্জ্য তৈরি হয়। সেই হিসেবে ঢাকায় দৈনিক ১৭৫ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা ওয়াসার দাবি অনুযায়ী ২০ ভাগ অর্থাৎ ৩৫ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য শোধন করছে। আর ওয়াসার হাতে থাকা একমাত্র শোধনাগারের (পাগলা পয়ঃশোধনাগার) মাধ্যমে এসব বর্জ্য শোধন করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ঢাকা ওয়াসার মডস জোন-১, ২, ৩, ৫, ৬ ও ৭ এর আওতায় পুরান ঢাকা, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুরসহ আশপাশের এলাকা, বাসাবো, গেন্ডারিয়া, গুলশান, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল, মালিবাগ, সেগুনবাগিচা, মগবাজার, দনিয়া এবং শ্যামপুর এলাকাজুড়ে ৯৬১ কিলোমিটার পয়ঃবর্জ্য সরবরাহ লাইন রয়েছে। এসব এলাকার পাইপলাইনের মাধ্যমে পয়ঃবর্জ্য পাগলা পয়ঃশোধনাগারে যাওয়ার কথা। কিন্তু, রক্ষণা-বেক্ষণের অভাবে এসব লাইনের বেশির ভাগ অকেজো হয়ে রয়েছে।
ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, গুলশান, বনানী, তেজগাঁও এলাকার পয়ঃবর্জ্য সংযোগ হাতিরঝিল এসে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। আর ধোলাইখালে পুরান ঢাকাসহ আশপাশের এলাকার পয়ঃবর্জ্য সংযোগ লাইন বিচ্ছিন্ন হয়েছে ধোলাইখালে। এখানে বিকল্প পাইপলাইন করে সামান্য পরিমাণ পয়ঃবর্জ্য পাগলা পয়ঃশোধনাগারে যাচ্ছে। বাকি পয়ঃবর্জ্য যত্রতত্র খাল, ডোবা, নালা এবং জলাশয়ে মিশে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে নগর বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসা ২০ শতাংশ পয়ঃবর্জ্য শোধন করার যে সক্ষমতার কথা বলছে, সেটাও আট বছর আগের। সে সময় প্রচুর অর্থ খরচ করে পানি ও পয়ঃবর্জ্য সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল ওয়াসা। এখন চিত্র তার চেয়েও খারাপ।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসার পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার কারণে ঢাকার ডোবা, নালা, খাল, জলাধার এবং চার পাশের নদীগুলো দূষণ করছে। এমন দূষিত পরিবেশের মধ্যে বসবাস করা আর স্বচ্ছ পানির ডোবা, নালা, খাল বা নদীর পাশে বসবাস করার মধ্যে পার্থক্য তো সবাই বুঝতে পারে। পানির বিলের সঙ্গে পয়ঃবর্জ্য বিল আদায় করে ঢাকা ওয়াসা মূলত গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় করছে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাছের খান যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকার পয়ঃবর্জ্যরে ২০ শতাংশ শোধনের যে দাবি করছে, এটা সঠিক নয়। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পয়ঃবর্জ্য শোধন করতে পারছে। বাকি পয়ঃবর্জ্য নদী, খাল, বিল, ডোবা, নালায় গিয়ে মিশছে।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসাকে এখান থেকে বের হয়ে আসতে হলে পর্যাপ্ত সংখ্যক পয়ঃবর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ করতে হবে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি ডা. মো. আবদুল মতিন বলেন, ‘পয়ঃবর্জ্য দূষণের কারণে খাদ্যনালী এবং চর্মজাতীয় সব ধরনের রোগ হয়ে থাকে। আর এসব রোগ দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্যান্সারে রূপ নেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার খাল, ডোবা, নালা ও জলাশয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই দেখা যায় সেগুলো জঘন্য রকমের পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত। এগুলো সরাসরি নদীতে গিয়ে মিশছে, অনেকে নদীর পানিতে গোসল করছে বা কাজের কারণে শরীরে লাগাচ্ছে। এ পানিতে চর্ম ও চোখের ইনফেকশন হচ্ছে। এছাড়া এমন দূষিত পানিতে লাখো কোটি জীবাণু রয়েছে। সেসব জীবাণু মানবদেহে জটিল রোগব্যাধি সৃষ্টি করে।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসা নগরীর পয়ঃবর্জ্য সমস্যার সমাধান করতে দাশেরকান্দি, উত্তরা, মিরপুর এবং রায়ের বাজারে নতুন চারটি এবং পাগলা পয়ঃশোধনাগারের আধুনিকায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে অবিভক্ত ঢাকার আয়তনের পয়ঃবর্জ্যরে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত এলাকার পয়ঃবর্জ্য শোধনাগার বাকি থাকবে। পরে ওইসব এলাকার সমস্যার পর্যায়ক্রমে সমাধান করা হবে।’
ঢাকা ওয়াসার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ১২৯ বর্গকিলোমিটার এলাকার পয়ঃবর্জ্যে সমস্যার সমাধান মিলবে। আর সেটা বাস্তবায়ন করতে সময় লাগবে ২০৩০ সাল বা তার চেয়ে কিছু বেশি সময় পর্যন্ত। এছাড়া সম্প্রসারিত ঢাকা বা ২৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকার পয়ঃবর্জ্য সমস্যার সমাধান করতে কতদিন সময় লাগবে, সেটা এখনো বলা সম্ভব নয়। তবে পয়ঃশোধনাগার নির্মাণসহ এ খাতের বরাদ্দ অব্যাহত রাখতে ২০৪১ সালের মধ্যে সম্প্রসারিত ঢাকাসহ রাজধানীর সব এলাকায় পয়ঃবর্জ্য সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে।
জানতে চাইল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গ্রাহকদের কাছ থেকে ওয়াসা পয়ঃবর্জ্য বিল আদায় বাবদ সেবা দেয়ার কথা। কিন্তু গ্রাহকরা পয়ঃবর্জ্য বিল পরিশোধ করলেও সেবা পাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসা পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নের লক্ষ্যে বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণ করলেও সেগুলো অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত। ঢাকা ওয়াসা বোর্ড ও মন্ত্রণালয় এগুলো দেখভাল করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উচিত এসব বিষষ খতিয়ে দেখা।’
ঢাকা ওয়াসার হিসাব বিভাগের তথ্যমতে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে পয়ঃবর্জ্য বাবদ বিল আদায় করেছে ১১২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৩৩ কোটি ৯ লাখ টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ১৬৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৯২ কোটি ৪১ লাখ টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২০৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২০৫ কোটি আট লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২১৬ কোটি ৯ লাখ টাকা আদায় করেছে।
এরপর প্রতি বছর ৫ শতাংশ পয়ঃবর্জ্য বিল বাড়িয়েছে ওয়াসা। সেই হিসাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পয়ঃবর্জ্য বিল আদায় করেছে ২২৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৩৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৫০ কোটি ১৪ লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৬২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা আদায় করেছে। আর সর্বশেষ চলতি (২০২০-২১) অর্থবছরে পয়ঃবর্জ্য বিল বাড়িয়েছে ২৫ শতাংশ। সে হিসেবে এবার গ্রাহকদের কাছ থেকে পয়ঃবর্জ্য বিল আদায় করবে ৩২৮ কোটি টাকা।