খবর৭১ঃ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা গুলিতে নিহত হওয়ার পরদিন (ঈদুল আজহার দিন) ঢাকার এক আওয়ামী লীগ নেতার মাধ্যমে একজন মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালান টেকনাফের বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।
৩১ জুলাই সিনহা হত্যাকাণ্ডের একদিন পর ঢাকার আওয়ামী লীগের একটি থানা কমিটির সভাপতির পদে থাকা ওই নেতাকে ফোনে প্রদীপ বলেন, মন্ত্রী বিষয়টি কতটুকু অবগত এবং পরবর্তীতে এটা নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে কি না, তা যেন নিশ্চিত হয়ে তাকে জানানো হয়।
আর কোনো সমস্যা হলেও যাতে তাকে (প্রদীপ) সমস্যায় পড়তে না হয়, সেটা মন্ত্রীকে জানাতে ওই নেতাকে অনুরোধ করেন প্রদীপ। প্রদীপ ও ঢাকার ওই নেতার ফোনালাপের একটি অডিওতে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে ঈদের দিন ওই নেতা মন্ত্রীর বাড়িতে যান। সিনহা হত্যাকাণ্ড নিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করেন। তবে মন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীসহ সকলকে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। এই ঘটনায় দোষী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
মন্ত্রীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওই নেতা প্রদীপকে ফোন করেন। বলেন- ‘আপনি যেটা সকালে বলেছিলেন সেটা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বিষয়টি জেনে গেছেন। আপনি সাবধানে থাকবেন, হয়ত আপনাকেও গ্রেপ্তার করা হতে পারে।’
উত্তরে প্রদীপ বলেন, ‘আমি তো কিছু করিনি, সব তো অফিসাররা করেছে।’ এসময় বারবারই আওয়ামী লীগের ওই নেতা প্রদীপকে সাবধানে থাকতে বলেন। পরে তিনি মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
গত ৩১ শে জুলাই রাতে টেকনাফের পাহাড়ে ভিডিওচিত্র ধারণ করে কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ দিয়ে হিমছড়ি এলাকার নীলিমা রিসোর্টে ফেরার পথে শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। এই ঘটনায় টেকনাফ থানার ওসিসহ নয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে নিহতের বোন।
এরপর পুলিশের সাত সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করে। পরে আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব। হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য ও পুলিশের মামলার সাক্ষী স্থায়ী তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পরিদর্শক লিয়াকত আলি, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত এবং এপিবিএনের তিন সদস্য রিমান্ড শেষে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। চার দফায় ১৫ দিন রিমান্ডে থাকলেও মেজর সিনহা হত্যায় নিজের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার। চতুর্থ দফার রিমান্ড শেষে মঙ্গলবার আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
সিনহার গাড়িতে মাদক দেয় প্রদীপ-লিয়াকত
পুলিশের গুলিতে নিহত মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদের গাড়িতে কোনও মাদকদ্রব্য ছিল না। হত্যাকাণ্ডের পর বিষয়টি ভিন্ন দিকে নিতে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার ও বাহারছড়া ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলি সিনহার গাড়িতে মাদক রাখেন। আর এসব মাদক থানা থেকে আনান ওসি প্রদীপ।
এছাড়া সিনহার গাড়িতে থাকা সিফাতকে গ্রেপ্তারের পর আরেক সহযোগী শিপ্রাকে ধরতে নীলিমা রিসোর্টে অভিযান চালায় পুলিশ। এসময় দুই বোতল ভদকা, তিন বোতল ভ্যাট-৬৯, এক পুরিয়া গাঁজা ও পানির বোতলে এক লিটার দেশীয় মদ উদ্ধার দেখিয়ে মামলা করে পুলিশ। এখানেও মাদক উদ্ধারের বিষয়টি সাজান প্রদীপ ও লিয়াকত।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার দীর্ঘদিন তদন্তে এমন তথ্য পেয়েছে। তারা বলছে, গাড়িতে মাদক দিয়ে সিনহা হত্যার বিষয়টি ভিন্ন দিকে নেওয়ার চেষ্টা করেন টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার ও বাহারছড়া ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলি।
ওসি প্রদীপের নির্দেশে গুলি করে লিয়াকত
ঘটনার দিন রাতে এপিবিএনের চেকপোস্টে যখন সিনহাকে থামানো হয়, তার আগে থেকেই চেকপোস্টের কাছে সাদা পোশাকে উপস্থিত ছিলেন বাহারছড়া ক্যাম্পের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলি ও এসআই নন্দলাল রক্ষিত। এপিবিএনের একজন সদস্য চেকপোস্টে মেজর সিনহার সিলভার রঙের প্রাইভেট কারটি থামার সংকেত দেন। কারটি একটু এগিয়ে গিয়ে থামে। কাছে যান এপিবিএনের ওই সদস্য।
পরিচয় জানতে চাইলে সিনহা নিজেকে সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর পরিচয় দেন। এসময় তিনি মেজর সিনহাকে চলে যেতে বলেন। হঠাৎই পরিদর্শক লিয়াকত দৌঁড়ে এসে গাড়ির চালকের আসনে থাকা ব্যক্তির পরিচয় জানতে চান। ‘ইংরেজিতে’ নিজেকে সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা পরিচয় দেন মেজর সিনহা। এরপরপরই প্রাইভেটকার থেকে প্রথমে নামানো হয় সিনহার ভিডিও ধারণের সহযোগী সিফাতকে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে থাপ্পড় দেওয়া হয় এবং জাপটে ধরে মাটিতে ফেলা দেওয়া হয়। এই ঘটনা দেখে সিনহা চালকের আসন থেকে দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন।
এ সময় সিনহাকে ‘হাত উঁচু’ করতে বলেই দূর থেকে পরপর দুটি গুলি করেন ইন্সপেক্টর লিয়াকত। সিনহার লাইসেন্স করা পিস্তল তখন গাড়িতেই ছিল। এরপর কাছে এসে আরও দুটি গুলি করেন পরিদর্শক লিয়াকত। এরপর সঙ্গে সঙ্গে মহাসড়কেই লুটিয়ে পড়েন মেজর সিনহা। পরে ঘটনাস্থলে এসে ওসি প্রদীপ অট্টহাসি দিয়ে গুলিবিদ্ধ সিনহার বুকের বাম পাশে পা দিয়ে আঘাত করেন। এরপর পা দিয়ে গলা চেপে ধরেন।