অন্য জ্বরেও চলছে করোনার চিকিৎসা

0
337
দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা ৪ লাখ অতিক্রম

খবর৭১ঃ করোনা ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। করোনার আগ্রাসী থাবায় যখন পুরো দেশের মানুষকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, তখন ঘরেও অন্য এক আতঙ্কে ভীত হয়ে পড়ছে সবাই। এই রোদ এই বৃষ্টির এমন আবহাওয়ায় ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী এডিস মশার প্রজনন বেড়ে গেছে। বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিদিন বাড়ছে এডিস মশার লার্ভা। একই সঙ্গে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও। কিন্তু বর্তমানে সবাই করোনা নিয়ে ব্যস্ত। জ্বর হলেই করোনার উপসর্গভিত্তিক চিকিত্সা দেওয়া হচ্ছে। অর্থাত্, অন্য জ্বরেও চলছে করোনার চিকিত্সা। কেউই রিস্ক নিতে চায় না। জ্বর হলেই অ্যান্টিবায়োটিকসহ করোনা প্রতিরোধক বিভিন্ন চিকিত্সা গ্রহণ করছে। এতে বেশির ভাগই ভুল চিকিত্সা হচ্ছে এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে। কারণ করোনা আর ডেঙ্গুর চিকিত্সা এক নয়।

বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকেরা বলেন, করোনা ও ডেঙ্গুর উপসর্গে রয়েছে পার্থক্য। তবে দুটির প্রধান উপসর্গ যেহেতু জ্বর, তাই জ্বর হলেই করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। রাজধানীতে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ভুল চিকিত্সা। মৃতদের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তরাও রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

অভিযোগ উঠেছে, অনেক চিকিত্সক জ্বর দেখলেই করোনার ভয়ে রোগীকে সেবা দিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। করোনা রোগীর চিকিত্সা করতে গিয়ে ডাক্তারদের আক্রান্ত হওয়া, কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনে চলে যাওয়াও চিকিত্সার ক্ষেত্রে ডেকে আনছে চরম বিপর্যয়। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারছে না কোনটা করোনা, কোনটা ডেঙ্গু আর কোনটা সাধারণ ফ্লু। এমনকি চিকিত্সাকেরাও একধরনের জটিলতায় পড়ে যাচ্ছেন। বিশ্বব্যাংকের হেলথ ইকোনমিস্ট ডা. শাকিল আহমেদ (৫৫) গত ২৮ আগস্ট রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তার জ্বর হয়েছিল।

করোনা মনে করে বাসায় ছিলেন। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ডা. শাকিল আহমেদকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে চিকিত্সকেরা পরীক্ষা করে দেখেন যে তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিলেন। শাকিল আহমেদের স্ত্রীও একজন চিকিত্সক। এদিকে জ্বরের উপসর্গ নিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোলরুমে ফোন করেন। এ সময় অপর প্রান্তে টেলিফোন রিসিভকারী চিকিত্সক আনুষঙ্গিক রোগীর অন্যান্য বিষয় না শুনে করোনার উপসর্গভিত্তিক চিকিত্সা গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কন্ট্রোলরুমে দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিত্সকদের বেশির ভাগই তাড়াহুড়া করে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে টেলিফোন রেখে দেন। এ ধরনের সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে রোগীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিসহ মৃত্যুরও আশঙ্কা থাকে।

করোনা ভাইরাসের মারাত্মক সংক্রমণ ধাপের মাঝেই দেশে ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয়েছে। মে-অক্টোবর মাস পর্যন্ত সময়টা ডেঙ্গুর মৌসুম। ডেঙ্গু এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। আর করোনা ভাইরাস ছড়ায় মানুষের হাঁচি-কাশি কিংবা হাত ও বস্তুর স্পর্শে ড্রপলেট আকারে। সেদিক থেকে করোনা ভাইরাসই বেশি সংক্রামক। করোনা ভাইরাস আর ডেঙ্গুর কিছু কিছু লক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে একই রকম হওয়ায় করোনা, নাকি ডেঙ্গু সংক্রমিত—সেটি বোঝা একটু কঠিন। প্রাথমিকভাবে প্রায় সব ভাইরাসজনিত রোগের উপসর্গই কিন্তু শুরু হয় জ্বর দিয়ে। ভাইরাল ফিভারে ছয় থেকে সাত দিন জ্বর থাকে। টাইফয়েড জ্বরে আস্তে আস্তে অল্প অল্প জ্বর হয়। রুচি থাকে না।

দ্বিতীয় সপ্তাহে জ্বর বাড়তে থাকে। ইনফ্লুয়েঞ্জায় জ্বরের পাশাপাশি গলাব্যথা ও শুকনো কাশিও থাকে। করোনা হলে জ্বর থাকবে। সঙ্গে হাঁচি, কাশি ও শ্বাষকষ্ট হবে। স্বাদ ও গন্ধচেতনার অবলুপ্তি হবে। রুচি না থাকার পাশাপাশি পাতলা পায়খানাও হয়ে থাকে। ডেঙ্গুর উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রচণ্ড জ্বর ও মাথাব্যথা, শরীরব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, শরীরে র্যাশ। দাঁতের গোড়ায় ব্রাশ করতে গেলে রক্ত আসে। নাক দিয়েও রক্ত পড়তে পারে। পায়খানার সঙ্গে রক্ত যেতে পারে।

করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীও বাড়ছে। করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুসহ অন্যান্য জ্বরের চিকিত্সা সম্পর্কে করণীয়বিষয়ক টেকনিক্যাল কমিটির পরামর্শ দুই-এক দিনের মধ্যে সরকারকে দেওয়া হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, জ্বর হলেই করোনা হয়েছে—এটা ভাবা উচিত নয়। উপসর্গ ভালোভাবে শুনে চিকিত্সা দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, তাড়াহুড়া করা যাবে না। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, জ্বর হলেই করোনা উপসর্গভিত্তিক চিকিত্সা দেওয়া যাবে না। কারণ এতে মৃত্যুঝুঁকির আশঙ্কা থাকে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, বিএসএমএমইউয়ে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুর পরীক্ষা করানো হচ্ছে। কারণ এখন ডেঙ্গুর মৌসুম। টেস্ট না করলে বোঝা যাবে না কার কী হয়েছে। সঠিক চিকিত্সার জন্য পরীক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরীক্ষা না করলে জটিলতার আশঙ্কা থাকে।

করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, জ্বর হলে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুর পরীক্ষা করানো উচিত। শুধু লক্ষণ দেখে চিকিত্সা দেওয়া যাবে না। কারণ অন্য রোগেরও লক্ষণ হলো জ্বর। পরীক্ষা না করলে মহাবিপদ নেমে আসবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন বলেন, জ্বর হলে করোনা টেস্ট করা উচিত। করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ হলে ডেঙ্গুসহ অন্য পরীক্ষা করতে হবে। রোগ নিশ্চিত না হয়ে রোগীর চিকিত্সা করলে রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here