খবর৭১ঃ
লেবাননের রাজধানী বৈরুতে মঙ্গলবার জোড়া বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭ জন হয়েছে। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার এ তথ্য দিয়েছে।
মর্মান্তিক এ ঘটনায় অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। এখনও নিখোঁজ আছেন অনেক মানুষ। বিস্ফোরণে শহরের প্রায় অর্ধেক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ঘরবাড়িহারা হয়েছেন তিন লাখের মতো মানুষ। লেবানিজ রেড ক্রস, সেনাবাহিনীর সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবীরা এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজদের উদ্ধারে কাজ করছেন। অনেক দেশ উদ্ধারকারী দল পাঠিয়েছে। স্বেচ্ছাসেবীদের আশঙ্কা, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। বৈরুতের হাসপাতালগুলো আহতদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসা দিতে এগিয়ে এসেছে অনেক দেশ। অনেক দেশ ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী পাঠাচ্ছে। ভয়াবহ এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা চেয়েছে লেবানন সরকার। বিস্ফোরণের পর বন্দর কর্মকর্তাদের গৃহবন্দি করা হয়েছে। নিহতদের স্মরণে তিনদিনের শোক পালন করছে লেবানন।
দুই সপ্তাহের জন্য জারি হয়েছে জরুরি অবস্থাও। এদিকে বিস্ফোরণের পর সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসছে সাধারণ মানুষ। তাদের অভিযোগ সরকারের অবহেলার কারণেই দেশের আজ এই অবস্থা। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ দাহ্য পদার্থের একটা বিহিত করার জন্য বারবার তাগাদা দিলেও সরকারের সংশ্লিষ্টরা আমলে নেননি। খবর বিবিসি, রয়টার্স, আলজাজিরা ও গার্ডিয়ানের।
মজুদ খাদ্যশস্যের ৮৫ শতাংশ ধ্বংস : বিস্ফোরণে লেবাননে মজুদ খাদ্যশস্যের ৮৫ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা খাদ্য দিয়ে মূলত দেশটি চলে। এই অবস্থায় খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়েছে দেশটি। কারণ এই মুহূর্তে বিভিন্ন দেশ থেকে দ্রুত খাদ্য আনা দেশটির জন্য কঠিন হবে। খাদ্যশস্যের এখন যা মজুদ আছে, তা দিয়ে দেশটি বড়জোর আর এক মাস চলতে পারবে।
এখনও অনেক মানুষ নিখোঁজ : বিস্ফোরণের ঘটনায় এখনও বহু মানুষ নিখোঁজ রয়েছে। বিশেষ করে ওই সময় যারা অফিসে কাজ করছিলেন। তাদের হন্যে হয়ে খুঁজছেন স্বজনরা। ভাইয়ের খোঁজ না মেলায় ক্ষুব্ধ ফাতিমা চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমি এখানে অপেক্ষা করছি, এখান থেকে নড়ছি না। আমার ভাই বন্দরে কাজ করত এবং বিস্ফোরণের পর থেকে আমরা তার কোনো খোঁজ পাচ্ছি না।’ বৈরুতের গভর্নর মারওয়ান জানিয়েছেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও অনেকে আটকে থাকায় মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে।
গৃহহীন তিন লাখ : বৈরুতকে তছনছ করে দেয়া বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহতের পাশাপাশি প্রায় তিন লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছেন বলে জানিয়েছেন শহরটির গভর্নর মারওয়ান আবুদ। বিস্ফোরণে বৈরুত শহরের অর্ধেক অংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
কেন বিস্ফোরণ : ছয় বছর আগে একটি কার্গো জাহাজ থেকে জব্দ করা অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট এতদিন বন্দরের গুদামে কেন পড়ে ছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। লেবাননের কাস্টমস প্রধান বাদ্রি দাহের বলেছেন, তার সংস্থা গুদাম থেকে ওই রাসায়নিক পদার্থগুলো সরিয়ে ফেলার জন্য তাগাদা দিলেও ‘কাজ হয়নি’।
ব্রিটেনের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের ধারণা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার শক্তির দশ ভাগের এক ভাগ বৈরুতের বিস্ফোরণে দেখা গেছে। সন্দেহাতীতভাবেই এটি ইতিহাসের অন্যতম বড় অ-পারমাণবিক বিস্ফোরণ।
বন্দর কর্মকর্তারা গৃহবন্দি : বিস্ফোরণের কারণ শতভাগ নিশ্চিত না হলেও ধারণা করা হচ্ছে, বন্দরের গুদামে অরক্ষিত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটকে দায়ী করা হচ্ছে। এসব বিস্ফোরক দ্রব্য যারা রেখেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে সরকার। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট হাতে না পাওয়া পর্যন্ত বন্দর কর্মকর্তাদের গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে।
দায়িত্বহীনতা ডেকে আনে বিপদ : বিস্ফোরণের পরেই বৈরুত বন্দরে বিপুল পরিমাণ বিপজ্জনক রাসায়নিক মজুদের বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। বন্দরটিতে ২ হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট রাখা ছিল, যা মূলত বোমা ও সার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে লেবানন পৌঁছায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটভর্তি একটি জাহাজ। রাশিয়ার মালিকানাধীন জাহাজটি ওই সময় মলডোভার পতাকা বহন করছিল। জাহাজের গতিবিধি শনাক্তকারী ওয়েবসাইট ফ্লিটমোনের তথ্যমতে, জাহাজটি তখন জর্জিয়া থেকে মোজাম্বিক যাচ্ছিল।
জাহাজের ক্রুদের পক্ষের আইনজীবীর ভাষ্যমতে, যাত্রাপথে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বৈরুত বন্দরে নোঙর করতে বাধ্য হয় জাহাজটি। কিন্তু লেবানিজ কর্মকর্তারা সেটিকে ফের যাত্রা করতে বাধা দেন এবং ঘটনাক্রমে জাহাজটি মালিক ও ক্রু উভয়ের কাছেই পরিত্যক্ত হয়। এরপর জাহাজটির বিপজ্জনক মালামাল বৈরুত বন্দরের ১২ নম্বর হ্যাঙ্গারের একটি ভবনে নামিয়ে রাখা হয়। এর কয়েক মাস পর ২০১৪ সালের ২৭ জুন একজন বেনামি ‘জরুরি ঘটনা বিষয়ক বিচারক’-এর কাছে কার্গো সমস্যার সমাধান চেয়ে চিঠি পাঠান তৎকালীন লেবানিজ কাস্টমসের পরিচালক শফিক মেরহি। পরের তিন বছরে আরও পাঁচবার চিঠি পাঠিয়েছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। ২০১৬ সালের একটি চিঠিতে আগের অনুরোধগুলোতে বিচারকরা কোনো সাড়া দেননি বলে উল্লেখ ছিল। চিঠিতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তিনটি উপায় জানিয়েছিল- বাজেয়াপ্ত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট রফতানি করা, লেবানিজ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা অথবা লেবাননের বেসরকারি বিস্ফোরক কোম্পানিগুলোর কাছে তা বিক্রি করা।
কিন্তু এরপরও কোনো জবাব আসেনি। এর এক বছর পর নতুন লেবানিজ কাস্টমস পরিচালক বাদ্রি দাহির বিচারকদের কাছে আবারও চিঠি লেখেন। ২০১৭ সালের ওই চিঠিতে বিচারকদের কাছে মালামালগুলো যেখানে রাখা হয়েছে সেই জায়গা ও সেখানকার কর্মীদের বিপদের কথা চিন্তা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন কাস্টমস পরিচালক। অথচ এরও প্রায় তিন বছর পর বিপজ্জনক অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বন্দরের ওই হ্যাঙ্গারেই রাখা ছিল।
লেবানিজ প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব বন্দরে বিস্ফোরণের ঘটনাকে জাতীয় বিপর্যয় বলে ঘোষণা দিয়েছেন এবং প্রতিজ্ঞা করেছেন, দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই মূল্য চুকাতে হবে। লেবানিজ প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলেছেন এবং এতে দোষীদের কঠোর শাস্তির ওয়াদা করেছেন। ঘটনা তদন্তে ইতোমধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাঁচদিনের মধ্যে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
হারিরি হত্যা মামলার রায় স্থগিত : বিস্ফোরণের কারণে নেদারল্যান্ডসের জাতিসংঘ সমর্থিত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরির হত্যাকাণ্ড নিয়ে মামলার রায় ঘোষণা স্থগিত করেছে। আজ এ রায় দেয়ার কথা ছিল।
ক্ষোভে ফুঁসছে বৈরুতবাসী : বিস্ফোরণের জন্য সরকারের অবহেলাকে দায়ী করছে সাধারণ মানুষ। বৈরুতের অধিবাসী চাদিয়া এলউচি এই মুহূর্তে হাসপাতালে লড়ছেন। ক্ষোভ উগড়ে তিনি বলেন, ‘আমি সব সময়ই জানতাম কতগুলো অযোগ্য লোক আর অযোগ্য সরকার এই দেশ পরিচালনা করছে। কিন্তু আমি বলতে চাই, এখন তারা যেটা করেছে, সেটা ভয়ংকর অপরাধ।’ চলচ্চিত্রকার জুড চেহাব বলেন, ‘বৈরুত কাঁদছে, বৈরুত চিৎকার করছে, মানুষ এখন উদ্ভ্রান্ত ও ক্লান্ত।’
স্বতন্ত্র তদন্ত দাবি : অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিস্ফোরণের ঘটনায় স্বতন্ত্র তদন্তের দাবি জানিয়েছে। তারা সরকারি তদন্তের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছে।