খবর৭১ঃ রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টির কারণে যে ‘পানিবন্দি’ অবস্থার সৃষ্টি হয়, তা এই মহানগরীর বিদ্যমান স্যুয়ারেজ ব্যবস্থায় নিরসন সম্ভব নয়। বর্তমান পয়ঃব্যবস্থাপনাকে নতুন আঙ্গিকে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মধ্যে নিয়ে আসা গেলেই বর্ষা মৌসুমের এই সংকট অনেকাংশে মিটে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকায় জলাবদ্ধতা ‘সহনীয়’ পর্যায়ে নিয়ে আসা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বারংবার আশার কথা শোনালেও রাজধানীবাসীর অভিজ্ঞতা কিন্তু এবারও আগের মতোই। সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তায় পানি জমে শুরু হয় ভোগান্তির।
বিপুল এই মহানগরীর জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে বিভিন্ন এলাকায় নালা ও খালগুলো দিয়ে পানি সরতে না পারাকে চিহ্নিত করে নানা প্রকল্পেও এই সংকটের সমাধান হচ্ছে না। এজন্য সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসা পরস্পরকে দোষারোপও করছে।
এবার করোনাকালের বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিতে রাজধানীর অনেক এলাকায় বাসা-বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। এমনকি বৃষ্টি থেমে গেলেও দুই থেকে তিন দিন পানিবন্দি থাকতে হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মানুষকে।
ঢাকার দুই নগর কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, অপ্রশস্ত ও নিচু কালভার্ট, অবৈধ দখল, কঠিন বর্জ্যে খাল ভরাট হয়ে যাওয়া, খালগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করা, খালের নির্গমন পথ সরু থাকায় পানি নিষ্কাশনে দেরি হয়ে আশপাশের এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এছাড়া প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ওয়াসার ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক অকার্যকর হয়ে পড়াকেও দায়ী করা হচ্ছে জলাবদ্ধতার জন্য।
তবে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার জলাবদ্ধতার জন্য ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি পাওয়াকে দায়ী করছেন ওয়াসার প্রকৌশল বিভাগের প্রধান শহিদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস আমরা আবহাওয়া অফিস থেকে সংগ্রহ করে সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থাও গ্রহণ করি। কিন্তু এবার বন্যার কারণে ঢাকার চারপাশের নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে।’
‘ফলে স্লুইজ গেইটগুলো দিয়ে যেভাবে স্বাভাবিক পানি নেমে যাওয়ার কথা তা সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য আমরা পাম্পিংও করেছি। প্রতি সেকেন্ডে ৫ হাজার লিটার পানি আমরা পাম্পিং করে বের করে দিচ্ছি।’
গেল সপ্তাহের টানা তিনদিন জলাবদ্ধতার ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে রাজধানীর রামপুরার মিরবাগ নতুন রাস্তা এলাকার বাসিন্দাদের। ড্রেনের পানি প্রথমে সড়কে এবং পরে তা ঢুকে পড়ে বাসাবাড়িতে। বেশকিছু বাসার নিচ তলায় জমে যায় হাঁটু পানি।
ভুক্তভোগী বিলকিস ইরানী বলেন, ‘রামপুরা মিরবাগ নতুন রাস্তা এলাকায় বাসার নীচতলা সব পানি সয়লাব হয়ে পড়ে। হাটুর উপর পর্যন্ত পানি। রাস্তায় ড্রেন ভর্তি পানি। তিন দিন এই অবস্থায় কাটাতে হয়েছে আমাদের।’
একই অবস্থা ছিল মিরপুরের মনিপুর, কাজীপাড়া ও বেগম রোকেয়া সরণি এলাকায়। কাজীপাড়ার বাসিন্দা নাসির উদ্দিন নাজমুল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বৃষ্টি হলেও বাসায় পানি চলে আসে। এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। কিন্তু সমাধান নেই। রাজধানীর মতো নগরে এমন অবস্থা অপ্রত্যাশিত। অথচ সেবা সংস্থাগুলোকে আমরা নিয়মিত ভ্যাট, ট্যাক্স দিয়ে যাচ্ছি। বিনিময়ে পাচ্ছি ভোগান্তি।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইসমাইল মোল্লা বলেন, ‘খাল অনেক জায়গায় দখল হয়ে গেছে। খালে নিয়মিত ময়লা ফেলার কারণে পানি চলাচল বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। খাল দখলের উদ্যেশ্যেও অনেকেই ময়লা ফেলছে। ফলে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা হচ্ছে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমাদের জবাবদিহিতা করতে হয়। কিন্তু আমাদের সক্ষমতা তো সীমিত।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর নগরের বর্তমান পয়ঃব্যবস্থাপনা অপরিকল্পিত। সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করা না হলে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান সারোয়ার জাহান বলেন, ‘নর্দমা ও পানি জমার জায়গাগুলো ভরাট করে ফেলা হয়েছে। সাধারণত পানির কিছু অংশ মাটির নিচে চলে যায়। বাকিটা খাল, নদীতে চলে যায়। ঢাকায় যেটা হয়েছে, বেশিভাগ এলাকা ভরাট করে ফেলা হয়েছে। তাহলে পানি কোথায় যাবে? পানি যেতে পারছে না। ফলে জলাবদ্ধতা হচ্ছে।’
বুয়েটের এই শিক্ষক বলছেন, রাজধানীতে আন্ডারগ্রাউন্ড পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। ঢাকার মাত্র ৩০ শতাংশ জায়গায় আন্ডারগ্রাউন্ডে পানি যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এর আবার পুরোটা ঠিকভাবে কাজও করে না। সারফেস ড্রেন দিয়ে পানি আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবে। কিন্তু এই ড্রেনগুলো ময়লা দিয়ে ভরে আছে। পানি যাওয়ার ব্যবস্থা নেই।
রাজধানীতে পরিকল্পিত আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন করতে না পারলে জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান হবে না বলে মনে করছেন সারোয়ার জাহান। বলেন, ‘আমাদের দেশে পানি নিষ্কাশনের আদর্শ নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা নেই। এটা শরীরের রক্ত সঞ্চালনের মতো। একটা ক্লিয়ার নেটওয়ার্ক দরকার, যেটা নেই।’
‘যতদিন স্যুয়ারেজ সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট না করা যাবে, এমনতা হতেই থাকবে। মাটি পানি শুষে নিবে আমরা সে ব্যবস্থা রাখছি না। অপরিকল্পিত নগরায়ন, অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি-ঘর বানাচ্ছি। সে কারণে এটা হচ্ছে।’