খবর৭১ঃ মহামারী করোনায় সংকটে পড়ে থমকে যাওয়া অর্থনীতির সঙ্গে গত চার মাসে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগও কমেছে। উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগমুখি করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখেই আগামী সপ্তাহে আসছে নতুন অর্থবছরের মুদ্রানীতি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানাভাবে ছাড় দেয়া হলেও ব্যাংকে প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা আসছেন না। আর বিনিয়োগকারীরা না এলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে না। এরপরেও মুদ্রানীতিতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর সব দরজা খোলা রাখার নীতিতে একমত হয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, করোনার প্রাদুর্ভাবে ব্যাংকের কার্যক্রমও কমে গেছে। দীর্ঘ চার মাস যাবৎ শুধু কিছু লেনদেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে বেশির ভাগ ব্যাংক। এ কারণে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগপ্রবাহ নিয়ে জুন মাসের হিসাব চূড়ান্ত হয়নি। চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
যেখানে মুদ্রানীতিতে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। উল্টো বেড়েছে সরকারের ঋণ। মুদ্রানীতিতে সরকারের ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। ১১ মাসে সরকারের ঋণপ্রবাহ লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ৪৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন হয়নি বিদায়ী মুদ্রানীতিতে। অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ ১৫ দশমিক ৯ শতাংশের বিপরীতে ১১ মাসে অর্জিত হয়েছে ১১ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক খাত থেকে এবারো সরকারকে বেশি মাত্রায় ঋণ নিতে হতে পারে। কারণ বিদায়ী অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এক লাখ কোটি টাকার ওপরে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু চলমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সরকারের ব্যয়নির্বাহ করতে ব্যাংক খাত থেকেই বেশি মাত্রায় ঋণ নিতে হবে।
অপরদিকে করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে নতুন বিনিয়োগ নিতে আসছেন না। কারণ বিদ্যমান ব্যবসাবাণিজ্যই যেখানে চালু রাখা যাচ্ছে না সেখানে নতুন বিনিয়োগের চিন্তাও করা যাচ্ছে না। দেশী-বিদেশী ভোগব্যয় কমে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে রপ্তানি আয় ও আমদানি ব্যয়ে। বিদায়ী অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক প্রায় ১৭ শতাংশ। এতেই বোঝা যায় বহিঃঅর্থনীতির চাহিদা কী হারে কমে গেছে। এ চাহিদা শিগগিরই বাড়বে না।
এদিকে অভ্যন্তরীণ চাহিদাও বাড়ছে না। গত মে মাসে আমদানি ব্যয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে কমেছে ৩১ শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে টাকা জোগান দেয়ার পদ্ধতি যতই সহজ করা হোক না কেন, প্রকৃত উদ্যোক্তারা বিনিয়োগমুখী হবেন না। তবে মৌসুমী কিছু রাঘববোয়াল ঋণগ্রহীতা আছেন, যারা সবসময়ই ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে চান। এদের নেওয়া বেশিরভাগ ঋণই বিনিয়োগে ব্যয় করা হয় না। নানা আইনের ফাঁক দিয়ে বিদেশে পাচার করা হয়।
এ কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের বের করে তাদের তহবিল জোগান দেয়াই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। তারপরেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা যেন সহজ শর্তে বিনিয়োগ পেতে পারেন সেজন্য মুদ্রানীতিতে সব দরজা খোলা রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
টাকার প্রবাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ:
সংশ্লিষ্টরা জানান, টাকার প্রবাহ বাড়াতে ইতোমধ্যে সকল পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়েছে। আমানতের বিপরীতে বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার দুই দফায় দেড় শতাংশ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন ব্যাংকগুলোর হাতে ২০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি চলে গেছে। এখন প্রতিদিন সাড়ে তিন শতাংশ এবং ১৫ দিন অন্তে চার শতাংশ সিআরআর সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। কোনো ব্যাংকে টাকার সঙ্কট দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেয়ার (রেপো) ব্যয় কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
এমনকি করোনা পরিস্থিতিতে ঘোষিত প্যাকেজ বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে এক বছরের জন্য ধার নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোর ঋণসীমা বাড়িয়ে ৮৫ শতাংশ থেকে ৮৭ শতাংশ করা হয়েছে। এতে বাড়তি ২৬ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
গত এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ করা হয়েছে। আর সরকার ঘোষিত প্যাকেজ বাস্তবায়নের জন্য চার থেকে সাড়ে চার শতাংশ সুদে ঋণ নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে ব্যবসায়ীদের। অপর দিকে ব্যাংকিং খাতে টাকার সঙ্কটের বিষয়টি মাথায় রেখে ৫০ হাজার কোটি টাকা প্যাকেজের অর্ধেক অর্থাৎ ২৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল জোগানের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগামী এক বছরের জন্য মুদ্রানীতি প্রণয়নে এসব বিষয় তুলে ধরা হবে। একই সাথে আপৎকালীন সময়ে উদ্যোক্তাদের টাকা পাওয়া সহজ করতে সব দরজাই খোলা রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। চলতি মাসের শেষ সপ্তাহেই এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।
প্রসঙ্গত, আগে প্রতি ছয় মাস অন্তর মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতো। কিন্তু গত বছর থেকে অর্থবছরের সাথে সামঞ্জস্য রাখার জন্য বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণার নিয়ম চালু করা হয়েছে।