খবর৭১ঃ
বন্ধ্যাত্ব সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা ও তার প্রতিকার জানালেন বিশেষজ্ঞ চিকিসকেরা।
বয়স ও জিনগত কারণ
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওভারিয়ান রিজ়ার্ভ কমতে থাকে। একটি মেনস্ট্রুয়াল সাইকলে উৎপন্ন হওয়া এগ-এর সংখ্যাকেই ওভারিয়ান রিজ়ার্ভ বলে। বয়স বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই ডিম্বাণু উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়। ফলে ফার্টিলাইজেশনও কমবে। এটি প্রেগনেন্সির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আবার বয়স বাড়লে জেনেটিক মেটেরিয়ালেরও বয়স বাড়বে। ফলে প্রেগনেন্সি এলেও ভূমিষ্ঠ সন্তান ডাউন’স সিনড্রোমে আক্রান্ত হতে পারে। আবার অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়, বয়সটা কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কমবয়সী একজন মেয়েরও ওভারিয়ান রিজার্ভ কম হতে পারে। এর কারণ অনেকসময়ই অজানা কোনও ভাইরাল অ্যাটাক যা অজান্তেই ওভারিতে প্রভাব ফেলেছে। সন্তান না আসার ফলে ডাক্তারি পরীক্ষা করানোর সময় এরকম কারণ ধরা পরতে পারে। সেক্ষেত্রে একজন ২৫ বছর বয়সী মহিলার ওভারির বয়স হতে পারে ৪৫! ওভারিয়ান এজিং সাধারণভাবে জানান দেয় অনিয়মিত পিরিয়ডের মাধ্যমে। অনিয়মিত পিরিয়ড হয় পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম আর প্রিম্যাচিওরড ওভারিয়ান ফেলিওর (পিওএফ)-এর কারণে। কম পরিমাণে পিরিয়ড, দু’-তিন মাস অন্তর পিরিয়ড হওয়া ইত্যাদি হতে পারে দ্বিতীয়টির লক্ষণ।
আলট্রাসোনোগ্রাফি বা ব্লাড টেস্ট করে যদি দেখা যায় পিসিওএস না হয়, তাহলে হতে পারে পিওএফ হয়েছে। নরমাল এএমএইচ হরমোন টেস্ট করে দেখে নেওয়া যেতে পারে। আবার ৩৭-৩৮ বছরের মহিলার পিরিয়ডের নির্দিষ্ট দিন যদি ক্রমশই এগিয়ে আসে, তাহলে তাঁর ফলিকল রাপচার হচ্ছে দ্রুত। ফলে তাঁর এগ-এর ফার্টিলাইজেশন পোটেনশিয়াল কম। ফলে তিনিও বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভুগবেন। তিন মাস পিরিয়ড অনিয়মিত হলেই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। আবার জিনগত কারণও উল্লেখযোগ্য। পরিবারে প্রিম্যাচিওরড মেনোপজ়ের ইতিহাস থাকলে আপনারও হতে পারে। আর্লি মেনোপজ় পরোক্ষভাবে পিওএফ-এর জন্য দায়ী। যদি দিদিমার আর্লি মেনোপজ় হয়ে থাকে ও মায়ের সঠিক সময়েই মেনোপজ় হয়, তাহলেও কিন্তু মেয়ের আর্লি মেনোপজ় হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। শুধু জিনগত ও বয়সজনিত কারণ নয়, সেডেন্টারি লাইফস্টাইল আর ক্রমবর্ধমান দূষণও বন্ধ্যাত্বের জন্য পরোক্ষে দায়ী। সাধারণত ২১ বছরের পর মা হওয়ার কথা ভাবা উচিত। আর তিরিশের কম বয়সীরা এক বছর ও তিরিশের বেশি বয়সীরা ছ’মাস চেষ্টা করেও যদি প্রেগনেন্সি না আসে, তাহলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ
আজকাল স্বামী-স্ত্রী নিয়মিত ইন্টারকোর্স করার সুযোগই পান না। পিরিয়ড শুরু হওয়ার দিন থেকে ধরলে এগারো নম্বর থেকে বাইশ নম্বর দিন পর্যন্ত নিয়মিত বা একদিন অন্তর মিলিত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সময়ের অভাবে সেটা আর হয়ে ওঠে না। আবার লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপের ক্ষেত্রেও এই একই সমস্যা হয়। এছাড়া ইনফার্টিলিটির অন্যতম কারণ হল পুরুষের অক্ষমতা। পুরুষের যৌনাঙ্গের সঠিক ইরেকশন না হওয়া অন্যতম বড় সমস্যা। নানা কারণের সঙ্গে ডায়াবিটিস, হাইপারটেনশন, ড্রাগ অ্যাবিউজ় ইত্যাদিও ইরেকশন না হওয়ার কারণ। একে বলে ইরেকটাইল ডিসফাংশন। এছাড়া স্টেরাইল ফ্যাক্টরও গুরুত্বপূর্ণ। কোনও পুরুষের সিমেনে স্পার্ম না থাকে, তাহলে তাঁকে স্টেরাইল বলা হয়। ফার্টিলিটির জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক স্পার্মের প্রয়োজন। যদি কম হয়, তাহলে তাকে বলে অলিগোস্পার্মিয়া আর যদি একেবারে না থাকে তাহলে তাকে বলে অ্যাজ়ুস্পার্মিয়া। যদি টেস্টিসে কোনও সমস্যার জন্য স্পার্ম কাউন্ট কমে যায়, তাহলে তা অত্যন্ত গুরুতর সমস্যা। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে টেস্টিসে স্পার্ম তৈরি হলেও বেরতে পারে না, তাকে অবস্ট্রাকটিভ অ্যাজুস্পার্মিয়া বলে। একজন মহিলার ক্ষেত্রে ইনফার্টিলিটির দু’রকম কারণ থাকতে পারে: ওভ্যুলেটরি আর টিউবাল। এগ-এর সঠিক ওভ্যুলেশন হচ্ছে কি না আর যে ফ্যালপিয়ান টিউবের সাহায্যে এগ আসবে, সেই টিউব ঠিক আছে কিনা—দু’টোই দেখে নেওয়া প্রয়োজন। এগ সঠিকভাবে উৎপাদন না হওয়ার অন্যতম কারণ হল পিসিও বা পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম। থাইরয়েডের সমস্যার জন্যও ওভ্যুলেশন ঠিকমতো হয় না। ফ্যালপিয়ান টিউবে ব্লকেজ অনেক কারণে হতে পারে। সেক্সুয়াল ট্রান্সমিটেড ডিজ়িজ়ের ফলে বা সেকেন্ডারি ইনফ্ল্যামেটরি ডিজ়িজ় থাকলে টিউবগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কেউ যদি অবিবাহিত অবস্থায় গর্ভপাত করিয়ে থাকেন, আর তার ফলে ইনফ্ল্যামেটরি ডিজ়িজ় হয়, তাহলেও টিউবাল ব্লকেজ হতে পারে। টিউবারকুলোসিস এখনও গ্রামের দিকে অনেকেরই হয়ে থাকে। গ্রেড থ্রি বা গ্রেড ফোর এন্ডোমেট্রিওসিসে টিউবাল ব্লকেজ হতে পারে। এমনিতে এন্ডোমেট্রিওসিসে ওভ্যুলেশন বাধাপ্রাপ্ত হয়। আবার কারওর সার্ভিক্সে যদি আর্লি ক্যানসার হয়ে থাকে, তাহলে সমস্যা হতে পারে। সার্ভিক্সের মধ্যে স্পার্ম পৌঁছলে একধরনের মেকানিকাল পরিবর্তন হয়। এর ফলে (ক্যাপাসিটেশন) স্পার্ম সক্রিয় হয়। সার্ভিক্সে কোনও অসুবিধে থাকলে এই প্রক্রিয়াটি বাধাপ্রাপ্ত হয়।
চেষ্টা করেও যদি প্রেগনেন্সি না আসে, তাহলে প্রাথমিকভাবে স্বামীর সিমেন টেস্ট আর স্ত্রীর দু’-তিনটে টেস্ট করতে হয়। আলট্রাসাউন্ড ফলিকিউলোমেট্রি করতে পারেন। এছাড়া আরও কয়েকটি টেস্ট করতে হতে পারে। এছাড়া ল্যাপারোস্কোপি করলেও বোঝা যায় টিউবে কোনও ব্লকেজ আছে কিনা বা ওভ্যুলেশন ঠিকমতো হচ্ছে কিনা। পিসিও থাকলে, যাঁদের অ্যান্ড্রোজেনিসিটি খুব বেশি, তাঁদের ক্ষেত্রে ওই মেল হরমোন কমানো আর ওষুধ বা ইনজেকশনের সাহায্যে ওভ্যুলেশন করানোর ব্যবস্থা করা হয়। এন্ডোমেট্রিওসিসের ক্ষেত্রে ল্যাপারস্কোপি করার পরে অনেকটাই সমস্যা দূর হয়। সিভিয়ার এন্ডোমেট্রিওসিসের ক্ষেত্রে সার্জারি দরকার হতে পারে। অপারেশনের পরেও চেষ্টা করে যদি প্রেগনেন্সি না আসে, তখন আইভিএফ-এর সাহায্য নিতে হবে।
লাইফস্টাইল মডিফিকেশন
মিসক্যারেজের সঙ্গে ওবিসিটির সরাসরি যোগ রয়েছে। যদি কারওর বডি মাস ইনডেক্স ৩০-এর বেশি হয়, তাহলে মিসক্যারেজের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আবার কোনও ওবিস মহিলা প্রেগনেন্ট হলে তাঁর রক্তচাপ, ডায়াবিটিস ইত্যাদির ঝুঁকিও থাকে। হেলদি প্রেগনেন্সি এক্ষেত্রে মুশকিল। স্ট্রেসের সঙ্গে ইনফার্টিলিটির সরাসরি যোগ না থাকলেও, পরোক্ষে এটি অবশ্যই দায়ী। স্ট্রেস, দাম্পত্য সম্পর্কে সমস্যা আর ব্যস্ত জীবনযাপনের ফলে নিয়মিত ইন্টারকোর্স করতে পারেন না অনেক দম্পতিই। ফলে প্রেগনেন্সি আসতে চায় না। ধূমপান খুব ক্ষতিকর। মহিলাদের ক্ষেত্রে ধূমপান ওভারিয়ান এজিং বেড়ে যায়। যেমন ধরুন, যাঁর বয়স ৩০, তাঁর এগ-এর বয়স ৩৫-৪০ বছর বয়সী মহিলার মতো! স্পার্ম কাউন্ট ঠিক থাকলেও, ছেলেদের ক্ষেত্রে ধূমপান স্পার্ম কোয়ালিটি খারাপ করে দেয়।
ক্যাফেন বা অ্যালকোহল বেশি পরিমাণে খেলে হবু সন্তানের জন্মগত খুঁত (কনজেনিটাল ম্যালফর্মেশন) হতে পারে। মোটের উপর হেলদি খাওয়াদাওয়া করা প্রয়োজন। প্রোটিন, কার্ব, ভিটামিন যেন রোজকার খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে। তিরিশ বছরের কম বয়সে মোটামুটি এক বছর নিয়মিত ইন্টারকোর্স করার পরে (সপ্তাহে দু’-তিন দিন) প্রেগনেন্সি না এলে ডাক্তারের কাছে আসা প্রয়োজন। আর তিরিশের উপরে ছ’মাস চেষ্টা করেই ডাক্তারের কাছে আসবেন।
ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন
সাধারণ মানুষ যাঁকে টেস্ট টিউব বেবি বলেন, সেটিই আসলে আইভিএফ-এর দ্বারা জন্মানো শিশু। সাধারণ পদ্ধতিগুলোর দ্বারা যদি প্রেগনেন্সি না আসে, স্পার্ম কাউন্ট ভাল না হয়, টিউবে ব্লকেজ থাকে তখন আইভিএফ-এর কথা ভাবা যায়। আইভিএফ-এর ক্ষেত্রে স্ত্রীর এগ থাকতেই হবে। আলট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে দেখে নেওয়া হয়, স্ত্রীর পর্যাপ্ত ফলিকলস আছে কিনা। স্বামীর স্পার্ম কাউন্ট মোটামুটি থাকলেও হবে। চল্লিশের কম বয়সী মহিলাদেরই আইভিএফ পদ্ধতির সাহায্যে নেওয়া উচিত। কারণ, চল্লিশের উপরে বয়স হলে নিজের এগ ব্যবহার করে সাফল্যের হার কমে। বেশি বয়সের এগ-এ ক্রোমোজ়োমাল সমস্যা থাকলে সন্তানের জেনেটিক সমস্যা হতে পারে। আইভিএফ সাধারণত দু’ভাবে করা হয়: অ্যাগোনিস্ট প্রোটোকল আর অ্যান্টাগনিস্ট প্রোটোকল। অ্যাগোনিস্ট প্রোটোকলে ইনজেকশনের মাধ্যমে নিজের এগ প্রডাকশন বন্ধ হয়ে যায়। এর ১৪ দিন পরে তাঁকে স্টিমুলেশন দিয়ে ওভারির মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা ফলিকলগুলোকে ধাক্কা মারে। এর ফলে অনেক ফলিকল একসঙ্গে বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে ফার্টাইল এগ-এর অপশন বাড়ে। এই এগ স্বামীর স্পার্মের সঙ্গে মিশিয়ে ভাল ভ্রূণের সম্ভাবনা তৈরি করা হয়। নিয়মিত ফলিকলের গ্রোথ দেখা হয় স্ক্যান করে। ফলিকলের মধ্যে এগ ম্যাচিওর করার জন্য ট্রিগার দেওয়া হয়।
এরপর ওই মহিলাকে সাময়িক ঘুম পাড়িয়ে রেখে ট্রান্সভ্যাজাইনাল রুটে এগ কালেক্ট করে নেওয়া হয়। হেলদি এগ আর হেলদি স্পার্ম বাছাই করে মিশিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যদি দেখা যায়, স্পার্ম কাউন্ট খুব কম, সেক্ষেত্রে এগ-এর চারিদিকে অসংখ্য স্পার্ম ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। তখন এধরনের বিশেষ মাইক্রোস্কোপ (ইন্ট্রা সাইটোপ্লাজ়মিক স্পার্ম ইনজেকশন)-এর সাহায্যে হাই ম্যাগনিফিকেশনে একটি এগ-এর ভিতরে একটি স্পার্ম ইনজেক্ট করা হয়। এটি কিছুটা ফোর্সড ফার্টিলাইজ়েশন। অ্যান্টাগনিস্ট প্রোটোকল এখন খুব জনপ্রিয়। তবে এক্ষেত্রেও এগ কালেকশন আর ফার্টিলাইজ়েশনের প্রক্রিয়া একই। আইভিএফ-এর সাফল্যের হার ৪০ শতাংশ মতো। প্রেগনেন্সি এলেও মিসক্যারেজের আশঙ্কা কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে থেকেই যায়। পজ়িটিভ প্রেগনেন্সি টেস্ট-এর হার বেশি হলেও টেক-হোম বেবি-র সংখ্যা তুলনায় কম। আজকাল ৩০-৩৫ বছরের মহিলাদেরও এগ-এর কোয়ালিটি খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এর পিছনে জীবনযাপনের ধরনও দায়ী অবশ্যই। এগ ডোনার আর স্পার্ম ডোনারের সংখ্যা আজকাল খুব বেড়ে গেছে।