খবর৭১ঃ করোনা পরীক্ষার নামে জালিয়াতির কথা স্বীকার করেছেন জেকেজি হেলথকেয়ার চেয়ারম্যান ও জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের চিকিৎসক (বরখাস্ত) ডা. সাবরিনা চৌধুরী এবং তার স্বামী (প্রতিষ্ঠানের সিইও) আরিফ চৌধুরী।
রিমান্ডে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে তারা পরস্পরকে দোষারোপ করছেন। জালিয়াতি নিয়ে তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জেকেজি ও ওভাল গ্রুপের আরও ৭ পরিচালককেও জিজ্ঞাসাবাদ করবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
তবে ‘তদন্তের স্বার্থে’ তাদের নাম বলছেন না সংশ্লিষ্টরা। এদিকে বেতনের স্লিপসহ নানা প্রমাণ উপস্থাপন করা হলেও ডা. সাবরিনা জেকেজির চেয়ারম্যান পদে থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আরিফের দাবি, তিনি এ প্রতারণায় নেমেছিলেন সাবরিনার প্ররোচনায়। আর সাবরিনা বলছেন, জেকেজি ও ওভাল গ্রুপের অনেকেই এ অপকর্মে যুক্ত।
আরিফ চৌধুরীর এমন অপকর্ম ও ব্যক্তিগত হয়রানির কারণে তিনি তাকে ডিভোর্সও দিয়েছেন। আরিফকে বিয়ে করার কারণেই আজ তার এমন পরিণতি।
সূত্র জানায়, আরিফ, সাবরিনা ও সাঈদকে প্রথমে আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এরপর তাদের দেয়া তথ্য যাচাই করতে তিনজনকে মুখোমুখি করা হচ্ছে।
বুধবার সন্ধ্যা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের তিন দফায় মুখোমুখি করা হয়। কিন্তু প্রত্যেকে নিজের দায় এড়িয়ে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছেন।
রাজধানীর মিন্টো রোডে বৃহস্পতিবার দুপুরে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, আরিফ ও সাবরিনা করোনা নিয়ে তাদের জেকেজি হেলথকেয়ারের ভুয়া রিপোর্টের কথা স্বীকার করেছেন। তবে কী পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন সেটা স্বীকার করেননি। অর্থ আত্মসাতের বিষয়টিও তদন্ত করা হচ্ছে।
বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে বুকিং বিডি ও হেলথকেয়ার নামে দুটি সাইটের মাধ্যমে টাকা নিচ্ছিল জেকেজি। তারা টাকা কোথায় রেখেছে তা খোঁজা হবে। ব্যাংকগুলো দেখা হবে।
তিনি বলেন, সাবরিনাকে ফের রিমান্ডে এনে মুখোমুখি করা হবে। এই কোম্পানিতে কার কী অবদান, কার কী দায়িত্ব ছিল তা তদন্ত করে দেখা হবে। যার যতটুকু দায় সেই অনুযায়ী তদন্ত হবে।
ডিবি সূত্র জানায়, আজ ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে ডা. সাবরিনাকে আদালতে হাজির করা হবে। বৃহস্পতিবারই তাকে হাজির করার চিন্তাভাবনা ছিল, তবে তদন্তের স্বার্থে সময় পেছানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে আরিফ গোয়েন্দাদের বলেন, ‘রিপোর্ট জালিয়াতির বিষয়টি সাবরিনার মাধ্যমেই শুরু হয়।’ এ সময় সাবরিনা ক্ষিপ্ত হয়ে আরিফকে বলেন, ‘টাউট, তোর জন্যই আমার সব শেষ হয়ে গেছে।’
গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, পরস্পরকে দোষারোপ করলেও আরিফ অনেক কিছুই স্বীকার করেছেন। আমরা পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। খুব দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে আদালতে চার্জশিট দেয়া হবে।
এ ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদফতরের কেউ সংশ্লিষ্ট আছে কিনা? জবাবে ডিসি বলেন, এসব বিষয়ে আমরা এখনও তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করিনি। তবে সব বিষয়েই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা পরীক্ষার জন্য ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করে জেকেজি তা ড্রেনে ফেলে দিত। আর লক্ষণ বুঝে পজিটিভ-নেগেটিভ সনদ দেয়া হতো বলে স্বীকার করেছেন আরিফ চৌধুরী।
করোনা মহামারীর মধ্যে এমন জালিয়াতি কেন করা হল- এ প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি আরিফ ও সাবরিনা। গোয়েন্দারা যতবারই প্রশ্ন করেছেন, তারা চুপ ছিলেন।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন স্থানে সাবরিনা নিজেকে জেকেজির চেয়ারম্যান পরিচয় দিয়ে আসছিলেন। তার জেকেজি কর্মচারীরাও তাকে সেভাবে চেনেন। প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা বেতন নিতে তিনি। বিভিন্ন স্থানে সাবরিনার পরিচয় দেয়ার প্রমাণ উপস্থাপন করলেও জিজ্ঞাসাবাদে তা অস্বীকার করেন সাবরিনা।
বরং তিনি একবার “স্বামী আরিফ চৌধুরীর নির্দেশে জেকেজিতে ‘স্বেচ্ছাসেবী’ হিসেবে কাজ করেছেন” বলে জানান, আরেকবার বলেন, ‘মুখপাত্র’ হিসেবে কাজ করেছেন।
এ সময় গোয়েন্দারা তার সামনে জেকেজি থেকে বেতন নেয়ার তিনটি স্লিপ উপস্থাপন করলে তিনি গোয়েন্দাদের পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন- এসব স্লিপ আপনারা পেলেন কোথায়?
চেয়ারম্যানের বেতন এত অল্প টাকা কেন- এ প্রশ্নে এক কর্মকর্তা বলেন, এটা তো সম্মানী হিসেবে দেখানো হতো। আসলে সবকিছুই তো তাদের। হয়তো অন্য স্টাফদের এটা বোঝানোর জন্য যে, চেয়ারম্যান হয়েও তিনি কত কম টাকা নেন।
করোনা রিপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগে ২৩ জুন আরিফ চৌধুরীসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে ৪টি মামলা হয়। আরিফকে থানায় নিয়ে এলে অনুসারীরা তাকে ছাড়িয়ে নিতে থানায় এসে ভাংচুর চালায়। এসব ঘটনায় ১৮ জন গ্রেফতার রয়েছেন।
এদিকে জেকেজির চেয়ারম্যান হিসেবে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনার সংশ্লিষ্টতা পায় পুলিশ। রোববার সাবরিনাকে গ্রেফতার করে পরদিন তিন দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়।
সাবরিনার দেয়া তথ্য যাচাই করতে আরিফ চৌধুরী ও তার ভগ্নিপতি সাঈদকে দিনের ৪ দিনের রিমান্ডে নেয় ডিবি। অভিযোগ রয়েছে, ডা. সাবরিনা প্রভাব খাটিয়ে লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠান জেকেজিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে করোনার নমুনা পরীক্ষার অনুমতি পাইয়ে দেন।
বিনামূল্যে নমুনা পরীক্ষার কথা থাকলেও তারা প্রতিটি নমুনা পরীক্ষা থেকে ৫ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। পুলিশের কাছে ১৫ হাজার ৪৬০টি ভুয়া পরীক্ষার প্রমাণ রয়েছে, যা থেকে কমপক্ষে ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সাবরিনা-আরিফ চক্র।
অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দুদকের : ডা. সাবরিনা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধানে কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থার পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, উপপরিচালক মোছা. সেলিনা আখতার মনিকে অভিযোগটি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
প্রণব কুমার আরও বলেন, এর আগে সরকারি চাকরিতে (চিকিৎসক, সার্জারি বিভাগ, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট) বহাল থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার, তার স্বামী আরিফ চৌধুরীর সহযোগিতায় প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে ১৫ হাজার ৪৬০ ভুয়া মেডিকেল রিপোর্ট প্রস্তুত ও সরবরাহ করে ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়াসহ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন।