খবর৭১ঃ একে একে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা ও মেঘনার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে গেছে। পদ্মার পানিও দ্রুত বাড়ছে। চট্টগ্রাম বিভাগের নদ-নদীর পানি দুই কূল ছাপিয়ে উপচে পড়ার অবস্থা। এতে দেশের ১৫ জেলায় ছড়িয়ে পড়া বন্যা আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে আরও ১০টি জেলায় ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে জানিয়েছে সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
সংস্থাটির গত সপ্তাহের পূর্বাভাসে মনে করা হয়েছিল, এই বন্যা সর্বোচ্চ চলতি মাস পর্যন্ত থাকতে পারে। কিন্তু গত তিন দিন ধরে বাংলাদেশের উজানে যে হারে বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে এই বন্যা আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত থেকে যেতে পারে। তাই যদি হয়, তাহলে ১৯৯৮ সালের ৩৩ দিনের বন্যার রেকর্ড ছুঁতে যাচ্ছে চলমান বন্যা। ’৯৮-এর পর দ্বিতীয় দীর্ঘস্থায়ী বন্যা ছিল গত বছর ১৭ দিন। চলমান বন্যা এরই মধ্যে ১৭ দিন অতিক্রম করে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, চলমান বন্যা এরই মধ্যে ১৭ দিন ধরে চলছে। এই মাসজুড়ে চলতে পারে। উজানে বৃষ্টি বেড়ে গেলে বন্যার স্থায়িত্ব আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত গড়াতে পারে। এর আশঙ্কাই বেশি। ফলে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে।
আরো পড়ুনঃ করোনাভাইরাস টেস্ট নিয়ে প্রতারণাঃ ডা. সাবরিনাকে ডিবিতে হস্তান্তর
করোনা সংক্রমণের এই সময়ে এত দীর্ঘস্থায়ী বন্যা দেশের গ্রামীণ জনপদের খাদ্যনিরাপত্তা তো বটেই, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মনে করছেন, এই বন্যায় আক্রান্ত মানুষদের সর্বোচ্চ সহায়তা দেওয়া উচিত। সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মনোযোগ দিয়ে ও বেসরকারি খাতকে যুক্ত করে এই বন্যা মোকাবিলায় উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী বলেন, বাংলাদেশ অনেক বছর এত বড় ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যার মুখোমুখি হয়নি। করোনার এই সময়ে আগের বন্যাগুলোর মতো ত্রাণ ও সহায়তা কার্যক্রম চালানো কঠিন হয়ে যাবে। তবে সরকারের উচিত বন্যার্তদের জরুরি ভিত্তিতে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া এবং তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা। এ কাজে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে যুক্ত করা উচিত। একই সঙ্গে বন্যার পর যাতে দেশে খাদ্যের সংকট না হয়, সে জন্য দ্রুত চালসহ অন্যান্য খাবার আমদানির জন্য বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দেওয়া উচিত।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, দুই বছর ধরে ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষকেরা বিপদে ছিলেন। গত মার্চ থেকে করোনার কারণে বোরো ধান শুকাতে ও বেচতে না পারা, কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা গবাদিপশু হাটে নিতে না পারার কারণে গ্রামীণ জনপদের মানুষের হাতে নগদ টাকার ঘাটতি রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে অনেক এলাকায় ফসল ও সম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণের সুযোগও অনেকে পায়নি। এরই মধ্যে বন্যা শুরু হওয়ায় সংকট আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।
সরকারের দিক থেকে বন্যার স্থায়িত্বের কথা চিন্তা করে এরই মধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত রোববার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউসের নেতৃত্বে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। জুম-এর মাধ্যমে অনলাইনে অনুষ্ঠিত ওই সভায় বন্যাকবলিত ১৫টি জেলার জেলা প্রশাসকেরা যোগ দেন। তাঁরা জানান, বন্যা পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ রূপ না নিলেও যেকোনো সময় পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে।
আরো পড়ুনঃ তিন দিনই থাকছে ঈদের ছুটি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলের বাইরে যেতে মানা
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। সব কটি জেলায় যথেষ্ট পরিমাণে চালের মজুত রাখা হয়েছে। আরও যে আর দশটি জেলায় বন্যা হতে পারে, সেখানেও ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ১৫টি জেলার ৪০১টি ইউনিয়নের প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার পরিবার বা ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছে। ১৪ লাখ মানুষ বন্যায় নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে গতকাল সোমবার পর্যন্ত বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে ৯৭৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখানে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, চলমান বন্যা যেভাবে দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে, তাতে সরকারের প্রথম কাজ হবে বন্যার্ত সব মানুষের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে ত্রাণ পৌঁছানো নিশ্চিত করা। আর কোথাও যাতে বাঁধ ভেঙে বন্যার পানি ঢুকে না পড়ে, তা নিশ্চিত করা। পানি নামার সময় নদীভাঙন বাড়তে পারে, সে ব্যাপারে মানুষকে আগে থেকে পূর্বাভাস দিয়ে প্রস্তুত রাখা।
আরো পড়ুনঃ করোনা মহামারীঃ ৪০ লাখ কোরবানির পশু অবিক্রিত থাকার আশঙ্কা
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের হিসাবে স্থায়িত্বের দিক থেকে চলমান বন্যা ’৯৮-এর মতো হলেও বিস্তৃতির দিক থেকে এটি এখনো অতটা বড় আকার নেয়নি। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বন্যা হিসেবে পরিচিত ’৯৮-এর বন্যায় দেশের ৬৩ শতাংশ এলাকা ডুবে গিয়েছিল। ১৯৮৮ সালের বন্যায় দেশের ৬৭ শতাংশ ও ২০০৭-এর বন্যায় ৫৩ শতাংশ এলাকা ডুবে যায়। তবে চলমান বন্যায় এখন পর্যন্ত দেশের ২৫ শতাংশ এলাকা ডুবেছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের ৪০ শতাংশ এলাকা ডুবে যেতে পারে।