খবর৭১ঃ
২১-৬-২০২০ রবিবার
দুপুর ০৩ঃ ০০
আজ ঘুম থেকে উঠতে একটু বেশি দেরি হয়ে গেল। ঘড়ির কাঁটায় দুপুর পার। রাতে সিআরআইর ইয়াং বাংলার ফেসবুক লাইভ। জানতে চাচ্ছিল কভিড নিয়ে সংযুক্ত হতে পারব কি না। বলেছি অবশ্যই। বললাম মরেটরে গেলে জীবনের শেষ ফেসবুক লাইভ হিসেবে এটার ভাইরাল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এহেন বক্তব্যে অন্য প্রান্তে ইয়াং বাংলার জয়েন্ট কো-অর্ডিনেটর বেচারি ইশরাতের চেহারার অবস্থাটা কী দাঁড়াল দেখতে খুব ইচ্ছা হচ্ছিল।
রাত ১১ঃ ০০
মাননীয় সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক ভাইয়ের সঞ্চালনায় ইয়াং বাংলার ফেসবুক লাইভটা ভালোই গেল। কথা হচ্ছিল মানুষ কেন কথা শুনছে না। আমার ধারণা, আমাদের কমিউনিকেশনের জায়গাটায় বড় ধরনের ঘাপলা আছে। যে মানুষ হ্যান্ডমাইকের ঘোষণায় দলে দলে, লাখে লাখে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে হাজির হয়, তারা কেন বুঝবে না লকডাউনকে ফাঁকি দেওয়া মানে ফাঁকি দেওয়া নিজেকেই। আমরা যদি জয় বাংলা কনসার্ট করে মুক্তিযুদ্ধ চেনাতে পারি আজকের তারুণ্যকে আর মিনা কার্টুন যদি ঢুকে গিয়ে থাকতে পারে আমাদের শিশুদের হাইজিন সেন্সের গভীর গহিনে, তাহলে কভিড কেন না? নতুন নতুন ওষুধ আর ভ্যাকসিন নিয়ে একেকবার একেক রকম আলোচনা আর টক শোতে বিশেষজ্ঞদের মতদ্বৈততা কি তাহলে ভুল মেসেজ দিচ্ছে মানুষকে? আমাদের জারি-সারি, লালন-ভাটিয়ালি, কবি আর পটের গান আর যাত্রা বা পুতুল নাচ কিংবা হ্যান্ডমাইকের মতো ট্র্যাডিশনাল কমিউনিকেশন টুলগুলোকেও কি আমরা পাশাপাশি আরেকটু ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারি না। এসব নিয়ে আলোচনা করতেই কোন দিক দিয়ে দেড় ঘণ্টা নেই। দুদিন বাদে আওয়ামী লীগের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। একাত্তরের আওয়ামী লীগের কাছে করোনাকালে ছোট্ট একটা প্রত্যাশা নিয়ে রাতে একটা লেখা লিখব জাগোনিউজের জন্য।
২২-৬-২০২০ সোমবার
সকাল ১১ঃ ০০
আলমগীর এসেছে। রক্ত পরীক্ষা হবে আমার। সিটি স্ক্যানে আমার ফুসফুসে কিছুটা চেঞ্জ আসায় এসব পরীক্ষা জরুরি। কভিড টেস্টটাও রিপিট করিয়ে নেব। সঙ্গে নুজহাতের আর সূর্যরটাও। আশা যদি নেগেটিভ আসে। মানুষ তো আশাতেই বাঁচে!
দুপুর ০৪ঃ ০০
আলমগীরের ফোন পেলাম আচমকাই। এবারে কোনো দুঃসংবাদ নেই। আমাদের তিনজনের রিপোর্টই নেগেটিভ। বিরাট মুক্তি। সূর্য তো আনন্দে রীতিমতো লাফাচ্ছে। তবে বন্দিদশা আপাতত কাটছে না। কাল দ্বিতীয় দফা পরীক্ষা হবে। সেখানে নেগেটিভ এলেই চূড়ান্ত মুক্তি।
করোনার আইসোলেশন কোনো সোজা বিষয় নয়। রুমে বসে থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার বিরল অভিজ্ঞতা অর্জনের বিরল সুযোগ এটি। সঙ্গে ঘর পরিষ্কার করা, প্লেট-বাসন ধোয়া, মশার ওষুধ মারা, আগ্রহভরে গাদা গাদা ওষুধ খাওয়া আর সবচেয়ে বড় কথা নিজের প্রতি ভালোবাসাটা ভালোভাবে রপ্ত করার সুযোগও এটা অবশ্যই। তা-ও আমার মতো দলে-বলে হলে ভালো। একলা হলে শ্রেফ মাথায় বাড়ি।
২৩-৬-২০২০ মঙ্গলবার
রাত ১১ঃ ৪০
আজ ঘুম থেকে উঠেছি বাদ আসর। ভাবা যায়? খেয়ে গোসল সারতে সন্ধ্যা। সন্ধ্যাটা কাটল কঠিন ব্যস্ততায়। প্রথমেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এশিয়ান টিভির টক শো। মাননীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান আর অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্যারের মতো হেভিওয়েট ব্যক্তিত্ব আলোচকের তালিকায়। ওটা শেষ না হতেই অপসোনিন ফার্মার ফেসবুক পেজ থেকে লাইভ টেলিমেডিসিন। আর সেটা কোনোমতে নাকে-মুখে শেষ করেই সম্প্রীতি বাংলাদেশের সম্প্রীতি সংলাপ। আজকের বিষয়বস্তু আওয়ামী লীগের ৭১তম জন্মদিন। শেষ হতে হতে রাত সাড়ে ১১টা।
আজ দেরিতে ওঠার কারণ সারা রাত জেগে আওয়ামী লীগের ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি। ঘুমিয়েছি সকালের সূর্য আকাশে অনেক দূর ওঠার পর। ঘাটতে গিয়ে একটা জিনিস খুব ভালোই বুঝেছি। এত দিন না বুঝেই বলেছি বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ আর বাংলাদেশ একে অপরের সমার্থক, আর এখন থেকে বলব ভালো করে বুঝে-শুনে। ভারত ভাগের আগেই বঙ্গবন্ধু একটা অখণ্ড বাঙালি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মুসলিম লীগ আর কংগ্রেসের প্রাদেশিক নেতৃত্বের সম্মতিও ছিল এতে। সম্মতি ছিল ব্রিটিশ রাজেরও। প্রস্তাবটা শেষমেশ ধোপে টেকেনি মুসলিম লীগ আর কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরোধিতায়। ভারত ভাগের পর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম দিয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নটিকে স্বপ্নের জায়গা থেকে মানচিত্রে নামিয়ে আনার জন্য। সম্প্রীতি সংলাপে পীযূষ দা যখন জানতে চাইলেন সম্প্রীতি বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগের জন্মদিন উদ্যাপনের ব্যাপারে আমার মন্তব্য তখন বললাম স্বাধীন বাংলাদেশে বসে যদি কোনো সংগঠন এই দিনটিকে উদ্যাপন না করে, তাহলে তা হবে নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা আর রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। আজ জাগোনিউজের আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নিয়ে আমার লেখাটা এসেছে। লিখেছি একটু গাটা ঝাড়া দিন। টানা সাড়ে ১১টি বছর ক্ষমতায় থাকার আত্মতুষ্টির সুযোগে ঢুকে পড়েছে কিছু সুযোগসন্ধানীর দল। একটু সতর্ক হলে শুধুই শুভ্রতা। কোথাও এতটুকুও কালিমা থাকবে না।
২৪-৬-২০২০
দুপুর ১২ঃ ০০
আজ আবারও স্যাম্পল টেস্ট করতে দিলাম। আলমগীর এসে নিয়ে গেল। আমরা যারা পজেটিভ সবার পরীক্ষাই রিপিট করালাম। শুধু রমজান ছাড়া। ওর মাত্র ছয় দিন হলো। হেলালের স্যাম্পল নিয়ে আমাদের বাসা হয়ে ল্যাবএইডে ফিরে গেল আলমগীর অ্যান্ড গং। লেমন ল্যাবএইডে গিয়ে স্যাম্পল দেবে। কাল মহামুক্তির প্রত্যাশায় সময় গুনছি।
রাত ১১ঃ ৩০
সম্প্রীতি বাংলাদেশের টেলিমেডিসিনের ১৩তম পর্বে আজ রোগীদের আরেক দফা লিভার রোগ নিয়ে পরামর্শ দিলাম। প্রথম পর্বটাও আমাকে দিয়েই শুরু হয়েছিল। ভালোই প্রগ্রাম হলো। এর পরপরই একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শহীদ মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ ইউনিটের একটা জুম মিটিংয়ে যোগ দিলাম। আগে থেকে শিডিউল করা ছিল না। তাদের অনুরোধে ঢেঁকিটা গেলা। কিন্তু ঢুকে অদ্ভুত ভালো লাগল। অদ্ভুত ডেডিকেশন ছেলেগুলোর। আগামী সপ্তাহে তাদের ইউনিটের পক্ষ থেকে তারা শহীদ মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজে পিপিই বিতরণ করবে। ভালো উদ্যোগ।
ইমনের বাবা ফজলুল হক মিয়া চাচাকে নিয়ে আমার একটা লেখা আজ জাগোনিউজ প্রকাশ করেছে। ভোরবেলায় লিখেছিলাম। চাচার মৃত্যুবার্ষিকী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন। অনেক দিন ধরেই লিখব লিখব করছিলাম। বাবার মৃত্যুর দিনটিতে ইমনের একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস একটু নাড়িয়ে দিল। শেষমেশ লিখেই ফেললাম। তবে লেখাটা যে তাদের পরিবারকে এতটা ছুঁয়ে যাবে বুঝিনি।
একটা ভালো খবর। রোটারি বাংলাদেশের ডিস্ট্রিক্ট সেক্রেটারি রোটারিয়ান আরিফ জেবতিক ভাই আমার ক্লাব সেক্রেটারি রোটারিয়ান পর্নাকে ফোনে জানিয়েছেন, আমরা রোটারি ইন্টারন্যাশনাল থেকে ‘প্রেসিডেনশিয়াল সাইটেশন’ পেয়েছি। আমাদের রোটারি ক্লাব অব ঢাকা জেনারেশন নেক্সটের বয়স দেড় বছরের মতো। এই সাইটেশনটা কোনো রোটারি ক্লাবের জন্য রোটারি ইন্টারন্যাশনালের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। যেকোনো রোটারি ক্লাবের জন্যই এটি একটি বড় ব্যাপার। দুই বছরের কম বয়সী রোটারি ক্লাবের জন্য তো অবশ্যই।
২৫-৬-২০২০
রাত ১১ঃ ৩০
অনলাইনে কানেকটেড ছিলাম বিডিনিউজএক্সপ্রেসের ফেসবুক পেজে। আমি-নুজহাত একসঙ্গে। সঙ্গে মাননীয় তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। কানেকটেড অবস্থায়ই প্রথমে ল্যাবএইডের এমডি ডা. শামীম ভাই আর জেনারেল ম্যানেজার ইফতেখার ভাইয়ের পর পর দুটি টেক্সট মেসেজ আর তার পরপরই আলমগীরের ফোনে জানতে পারলাম আমাদের তিনজনের সেকেন্ড স্যাম্পল নেগেটিভ এসেছে। নেগেটিভ এসেছে হেলালসহ বাদবাকিদেরও। বাদ পড়েছে শুধু লেমন। মুক্তির গান বাজছে চারদিকে। কাল আইসোলেশন থেকে মুক্তি। তবে কোয়ারেন্টিন শেষে কাজে ফিরতে আরো দিন সাতেক।
গতকালই ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারে বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি বুদ্ধপ্রিয় মহাথেরো ভিক্ষুর নেতৃত্বে আমাদের রোগমুক্তির জন্য বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়েছে সুদূর বিহারে বুদ্ধ গয়ার গৌতম বুদ্ধের বোধিবৃক্ষের পাদদেশেও। এদিকে স্বপন মামা কলকাতায় বসে প্রার্থনা করেছেন জগন্নাথদেবের কাছে দোলযাত্রার দিনে। অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা যে এ দেশের মানুষগুলোর হূদয়ের এত গভীরে প্রোথিত কভিডে আক্রান্ত না হলে এই বোধটুকু আমার কখনোই হতো না। নতুন করে আবার চেনা, চিরচেনা এই বাংলাদেশে কাল থেকে আবার নতুন করে চলতে শুরু করব—এই প্রশান্তি নিয়ে একটু পরেই ঘুমাতে যাব।