খবর৭১ঃ করোনা মহামারির কারণে লকডাউন ঘোষণার পর দুই মাসে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের পরিমাণ ব্যাপক হারে কমেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বাল্যবিবাহের সংখ্যা। আবার বেড়েছে ঘরে সন্তান প্রসবের প্রবণতা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় এ বছর প্রায় ২ লাখ ৩৫ হাজার অতিরিক্ত শিশু জন্ম নেবে। জাতিসংঘ শিশু তহবিলও দেশে জন্মহার বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। সাধারণ সময়ে দেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ শিশু জন্ম নেয়।
স্বাস্থ্যবিদ ও জনসংখ্যা বিশারদদের মতে, বাল্যবিবাহ ও ঘরে সন্তান প্রসবের সংখ্যা বাড়ায় মেয়েশিশু ও নারীদের প্রজননস্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের ওপর।
এরই মধ্যে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। এবারের দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ‘মহামারির কোভিড-১৯–কে প্রতিরোধ করি, নারী ও কিশোরীর সুস্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করি’।
করেনা মহামারির মধ্যেই গত মে মাসে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। আবার এর মধ্যে শুরু হয়েছে বন্যা। এই তিন ধরনের দুর্যোগের মধ্যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের বেহাল দশা।
করোনা পরিস্থিতিতে দেশে গত ২৬ মার্চ থেকে ‘সাধারণ ছুটির’ আদলে লকডাউন শুরু হয়। এটি দফায় দফায় বাড়িয়ে শেষ হয় গত ৩০ মে। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) গত ৬ মে এক প্রতিবেদনে প্রক্ষেপণ করেছে, করোনার কারণে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ায় পরবর্তী ৪০ সপ্তাহে ২৪ লাখ শিশুর জন্ম হতে পারে। সংস্থাটির আশঙ্কা, করোনাকালে জন্মকালীন পরিচর্যা এবং অন্তঃসত্ত্বা মা ও শিশুর জীবন রক্ষার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে।
জনসংখ্যাবিদ ও গবেষকেরা বলছেন, লকডাউনের শুরুতে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি একেবারে স্থবির হয়ে গিয়েছিল। তাতেই এই অতিরিক্ত গর্ভধারণ হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, এই তিন দুর্যোগে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা। অধ্যাপক মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ লাখ শিশু জন্ম নেয়। সেই হিসাবে, করোনা–পরবর্তী নয় মাসে অন্তত ২ লাখ ৩৫ হাজার অতিরিক্ত শিশুর জন্ম হবে।’
বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর চাহিদা অর্ধেকটা সরকারি পরিষেবা থেকে এবং বাকিটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পূরণ হয়। জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে পিল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। সামগ্রী ব্যবহারের অর্ধেকই পিল। বাকি অর্ধেকের মধ্যে আছে ইনজেকশন, কনডম, নারী ও পুরুষের বন্ধ্যাকরণ, ইমপ্লান্ট ইত্যাদি। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিল ও মে মাসে পিল ও কনডমের ব্যবহার কমে যায় প্রায় ৩০ শতাংশ। স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের পরিমাণও কমে যায় ব্যাপকভাবে। যেমন জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে গড়ে প্রায় তিন হাজার ভ্যাসেকটমি (পুরুষের বন্ধ্যাকরণ) হলেও এপ্রিল মাসে এ সংখ্যা ছিল ২৬৩ এবং মে মাসে ১২১। নারী বন্ধ্যাকরণ বা কিউবেকটমির সংখ্যা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ছয় হাজারের ওপরে হলেও এপ্রিলে এর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৮০০ আর মে মাসে এ সংখ্যা ২ হাজার ৬০০।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জনসংখ্যা গবেষণা প্রতিষ্ঠান পপুলেশন কাউন্সিলের দেশীয় পরিচালক ও জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ ওবায়দুর রব গতকাল শুক্রবার বলেন, ‘কোভিডের কারণে আমরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে বেশ পিছিয়ে গেছি। এর কারণে জনসংখ্যা কিছু বাড়বে। এখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে বাড়তি গতি দরকার।’
অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি রওশন আরা বেগম বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে পরিবার পরিকল্পনার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার জন্য আমরা পরামর্শ দিয়েছিলাম পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরকে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। এটা তারা স্বীকারও করেছে। লোকবল, সামগ্রীর স্বল্পতাসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা জানিয়েছে অধিদপ্তর।’
করোনার কারণে প্রাথমিকভাবে সবকিছু স্থবির হয়ে যাওয়ায় এর প্রভাব জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের ওপর পড়েছে, তা স্বীকার করেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (এমসিএইচ-সার্ভিসেস) মোহাম্মদ শরীফ। তিনি বলেন, ‘কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। প্রাথমিকভাবে কার্যক্রম কিছুটা কম থাকলেও পরে বেড়েছে। এখন অবস্থা স্থিতিশীল আছে।’
দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করে সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি (এসএমসি)। বেসরকারি খাতে দেশে এটিই সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। এসএমসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলী রেজা খান জানান, এ বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় এপ্রিল, মে ও জুন মাসে তাঁদের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সরবরাহ বেড়ে গেছে। আলী রেজা খান বলেন, ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর অন্য উৎস থেকে সরবরাহ কমে যাওয়ায় আমাদেরটা বেড়ে গেছে।’বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এসএমসির জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি ইঙ্গিত দেয়, সরকারি সরবরাহ কমে যাওয়ায় মানুষ বেসরকারি খাতের দিকে ঝুঁকেছে।
এ অবস্থার মধ্যেই এসে পড়েছে বন্যা। দেশের অন্তত ২৪টি জেলায় বন্যা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে বেশ পিছিয়ে থাকা সিলেট অঞ্চলও রয়েছে।
ইউএনএফপিএর হিউম্যানিটেরিয়ান স্পেশালিস্ট মুর্শিদা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোভিডের কারণে এমনিতেই মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিতে দূরে থাকছে। এর মধ্যে বন্যার মতো দুর্যোগে জনসংখ্যা কার্যক্রমের মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা আছে। এর জন্য সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (এমসিএইচ-সার্ভিসেস) মোহাম্মদ শরীফ বলেন, ‘বন্যার বিষয়টি আমাদের বিবেচনার মধ্যে আছে। অন্তত ছয় মাসের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর মজুত আছে। আর এ সময় ইনজেকশনের ব্যবহার বাড়ানোর চিন্তা আছে।’
বাড়িতে সন্তান প্রসব বেড়েছে ২৩ শতাংশ
করোনার কারণে বাড়িতে সন্তান প্রসবের হার বেড়েছে ২৩ শতাংশ। জনস্বাস্থ্যবিদ ও সরকারের করোনাবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য আবুল জামিল ফয়সাল সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের এক সভায় এ–সংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করেন। সেখানে দেখা যায়, গত বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে চারবার প্রসবপূর্ব সেবা নিয়েছিলেন ২০ হাজার ৩২৬ জন নারী। এ বছর এ সময়ে এ সেবা নেওয়া নারীর সংখ্যা ১৫ হাজার ৬৩১ জন। গত বছর এই দুই মাসে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় স্বাভাবিক প্রসব হয়েছিল ২৫ হাজার ১৯২টি। এ বছর হয়েছে ২০ হাজার ৯০০টি।
আবু জামিল ফয়সাল গতকাল বলেন, বাড়িতে প্রসব বেড়ে যাওয়ায় সংকট বেড়েছে। সরকারি তথ্যে দেখা গেছে, প্রসূতিদের খিঁচুনি বেড়েছে। প্রসবপরবর্তী রক্তক্ষরণও বেড়েছে। খিঁচুনি ও প্রসবপরবর্তী রক্তক্ষরণ দেশে মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ।
বেড়েছে বাল্যবিবাহ
করোনাকালে দেশে বেড়েছে বাল্যবিবাহ। আন্তর্জাতিক সংগঠন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল কুড়িগ্রাম জেলার বাল্যবিবাহের ঘটনা নজরদারি করে। সংস্থার এক প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে জেলায় বাল্যবিবাহের সংখ্যা ছিল ৮ শতাংশ। এপ্রিলে এসে এটি ১ শতাংশ বেড়ে যায়। মে মাসে মোট বিয়ের ১১ শতাংশ বাল্যবিবাহ হয়।
বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি বিভাগের মে মাসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাল্যবিবাহ আগের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেড়ে গেছে।
যদিও সরকারের নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী রওশন আক্তার গত ৩০ জুন জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএফপিএ) সভায় বলেন, ‘করোনাকালে বাল্যবিবাহ বাড়ছে—এমন কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই।’
তবে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো আরও দ্রুত গর্ভধারণ, এমনটাই মনে করেন অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম।
সূত্রঃ প্রথম আলো