স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি অনিয়মের তদন্ত শুরু

0
387
দুদকের তালিকায় স্বাস্থ্যের দুই ডজন কর্মকর্তা

খবর৭১ঃ

স্বাস্থ্য খাতে বিগত ১০ বছরের দুর্নীতি ও অনিয়ম তদন্তে ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে একটি বিশেষ সংস্থাকে।

সম্প্রতি করোনাসামগ্রী কেনাকাটা, মাস্ক কেলেঙ্কারি ও রিজেন্ট হাসপাতাল কেলেঙ্কারিসহ স্বাস্থ্যের সব অনিয়মের তদন্ত এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। কাউকে ছাড় না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জানা গেছে, তদন্তের আওতায় থাকবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর, ওষুধ প্রশাসনসহ এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সব অধিদপ্তর, বড় বড় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বিভাগীয় স্বাস্থ্য অফিস, সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ স্থানীয় স্বাস্থ্য প্রশাসন।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বিগত ১০ বছরে স্বাস্থ্য খাতে বড় ধরনের সাগর চুরির ঘটনা ঘটেছে। কোটি কোটি টাকা দিয়ে তদবিরের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আসেন অসত্ কর্মকর্তারা। এরপর তারা নানা অনিয়মের মাধ্যমে নিজেদের আখের গোছান। এ কারণে করোনা দুর্যোগের মধ্যে ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের মধ্যে নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বড় সিন্ডিকেট জড়িত।

করোনা পরীক্ষায় ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার স্পর্ধাও দেখিয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল। এর মালিক মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের অপকর্মের সঙ্গে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা জড়িত। সাহেদের টাকায় অনেকেই বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। অথচ রিজেন্ট হাসপাতালসহ মাস্ক ও করোনাকালে কেনাকাটায় কেলেঙ্কারির ঘটনার পর গুটিকয়েক কর্মকর্তাকে বদলি ছাড়া কারোর বিরুদ্ধে বড় কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তবে এবার হাইকমান্ডের নির্দেশে শুরু হয়েছে তদন্ত।

তদন্তে যাদের নাম আসবে তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। সাহেদের সঙ্গে বর্তমান ও বিএনপি আমলের ক্ষমতাধর মন্ত্রী-এমপিদের সম্পর্ক রয়েছে। এদিকে নার্সিং কাউন্সিলের এক কর্মকর্তা এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেলেও ১২ বছর ধরে তিনি বহাল তবিয়তে আছেন এবং নানা দুর্নীতিতে জড়িত বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সাম্প্রতিক কালে টেলিফোনে টাকা-পয়সা লেনদেনের একটি অডিও-ভিডিও রেকর্ড গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এসেছে। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব পদমর্যাদার এক জন কর্মকর্তার নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার ও মোহাম্মদপুরে বিপুল সম্পদের সন্ধান পেয়েছেন তদন্ত টিমের কর্মকর্তারা। সম্প্রতি মাস্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহকারীর সঙ্গে জড়িতরা সরকারবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডেও জড়িত রয়েছে বলে তথ্য এসেছে।

জানা গেছে, এসব কর্মকর্তা ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। তারা ঘাপটি মেরে থেকে সরকারের সঙ্গে মিশে ছিল। এসব কিছুই তদন্ত করে বের করা হচ্ছে। সরকারের হাইকমান্ডের নির্দেশে নিখুঁতভাবে তদন্ত চলছে। যেখানে যার অবৈধ সম্পদ পাওয়া যাবে, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। উল্লেখযোগ্য ১১টি খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিত্সাসেবা, চিকিত্সা সরঞ্জাম, ওষুধ সরবরাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। স্বাস্থ্য খাতে বেশির ভাগ যন্ত্রপাতিই কেনা হয়েছে চাহিদাপত্র ছাড়াই। ‘এ’ ক্যাটাগরির যন্ত্রপাতির মূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে ‘সি’ ক্যাটাগরির যন্ত্রপাতি। কখনো কখনো দেশে থেকেই যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে কোনো নামকরা বিদেশি কোম্পানির।

অথচ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আমলে দেশে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনসহ স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক পরিকল্পনা। তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে গ্রাম পর্যায়েও হেলথ কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের বৈপ্লবিক কর্মসূচির বাস্তবায়ন করেছে সরকার। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের এক বড় অংশ মহাচোরদের পকেটে জমা হচ্ছে। এমনকি করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যেও থেমে নেই স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি।

করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ল্যাবরেটরি যন্ত্রপাতি, পিপিই, টেস্টিং কিট, ওষুধপত্র ইত্যাদি চিকিত্সাসামগ্রী কেনাকাটায় অন্তত ২২ কোটি টাকার সঠিক হিসাব দিতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, স্বাস্থ্য খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

এদিকে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় দুর্নীতি-অনিয়মে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ১৪ ঠিকাদারকে ‘কালো তালিকা’ভুক্ত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দুদকের তদন্তে এদের নাম উঠে আসায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. বেলাল হোসেন স্বাক্ষরিত এ নির্দেশনা দেশের সব হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, সরকারি অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণসহ ক্রয় কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনা এবং দুর্নীতি, প্রতারণা ও চক্রান্তমূলক কার্যকলাপে জড়িত ছিল ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান ও তাদের মালিকদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদক মামলা করে সে তালিকা পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে।

যেসব ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এবং রূপা ফ্যাশনের মালিক রুবিনা খানম। রুবিনা খানম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব রক্ষক মো. আবজাল হোসেনের স্ত্রী। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত প্রায় ২৮৫ কোটি টাকা পাচার এবং ৩৪ কোটি টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত বছর এই দম্পতির বিরুদ্ধে দুইটি মামলা করেছিল দুদক।

এছাড়া মেসার্স অনিক ট্রেডার্সের মালিক আব্দুল্লাহ আল মামুন, মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজের মুন্সী ফররুখ হোসাইন, মেসার্স ম্যানিলা মেডিসিন অ্যান্ড মেসার্স এস কে ট্রেডার্সের মনজুর আহমেদ, এমএইচ ফার্মার মোসাদ্দেক হোসেন, মেসার্স অভি ড্রাগসের মো. জয়নাল আবেদীন, মেসার্স আলবিরা ফার্মেসির মো. আলমগীর হোসেন, এস এম ট্রেডার্সের মো. মিন্টু, মেসার্স মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মো. আব্দুস সাত্তার সরকার ও মো. আহসান হাবিব, বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিকেল কোম্পানির মো. জাহের উদ্দিন সরকার, ইউনিভার্সেল ট্রেড করপোরেশনের মো. আসাদুর রহমান, এ এস এলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আফতাব আহমেদ এবং ব্লেয়ার এভিয়েশনের মো. মোকছেদুল ইসলামকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

‘মাস্ককাণ্ডের’ পর জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও তমা কনস্ট্রাকশনের সমন্বয়কারীকে বুধবার পাঁচ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here