খবর৭১ঃ
রাত ০১:৩০
মাত্রই ডিনার শেষ করলাম। গত কয়েক ঘণ্টায় ছোটখাটো একটা ঝড় বয়ে গেছে। পজিটিভ এসেছে রিমার, বাসায় থাকে, টুকটাক কাজ করে। সঙ্গে পজিটিভ হেলালও। এত দিনের ছায়াসঙ্গী কভিডেও সঙ্গ ছাড়েনি। বাসার ড্রাইভারসহ অন্যরা নেগেটিভ। তবে আমার ড্রাইভার সাবেরের রিপোর্টটা কেন যেন আসেনি।
রিপোর্টগুলো পাওয়ার পর থেকেই একের পর এক ফোন, ওষুধের জন্য যোগাযোগ। মানুষের অদ্ভুত ভালোবাসায় মাঝেমধ্যে কাঁদিনি বললে মিথ্যা বলা হবে। ফোন করেছিলাম পলবকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একসময়কার নেতা পলব পেশায় ফার্মাসিস্ট। এখন বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের ভাইস প্রেসিডেন্ট। ফেভিপিরাভিরের জন্য বললাম। বলল, পাঠিয়ে দেবে সকাল-সকাল। বললামÑএকজনের জন্য না, ওষুধ চাই সবার জন্য। কভিডের মতো আমিও পরিবারের সদস্য ও গৃহকর্মীর মধ্যে ভেদাভেদ করব না। অবাক করা উত্তর পেলাম। সকালবেলা ওষুধ আসবে, আসবে সবার জন্যই এবং বিনা মূল্যে। শুধু ছোট্ট একটাই অনুরোধ, আজ রাতের মতো যেন চালিয়ে নিই আমার নিজের ফেভিপিরাভিরের বরাদ্দটা থেকে। ল্যাব সায়েন্সের স্বত্বাধিকারী ফারুক সাহেব। চোখের সামনে তড়তড়িয়ে বড় হতে দেখলাম ভদ্রলোকের ডায়াগনস্টিক সেন্টারটা আর সেই সঙ্গে তাঁকেও। শুধু বড় হননি দৈর্ঘ্যে আর ভাবভঙ্গিতে। বাসায় অনেকগুলো লেবু আর ডিম পাঠিয়ে দিয়েছেন। কী হিসাব জানি না, তবে বুঝতে পারছি, হিসাব করে এই ডিম-লেবুর হিসাব মেলানো যাবে না। কিংবা এসকেএফের ডিরেক্টর ডা. মুজাহিদ। কদিনেরই বা পরিচয়। স্টেম সেল নিয়ে দু-তিন দফা বসা হয়েছে। বলা মাত্র রাজি হয়ে গেলেন রেমডেসিভির পাঠিয়ে দিতে। রাজি রেডিয়্যান্ট ফার্মাসিউটিক্যালসের রেজাও। টসেলিজুমাভের কথা বলতেই এককথায় আস্বস্ত করল। ডা. সুনান ইদানীং আমার নানা কাজের সহযোগী। চেম্বারে আনাগোনাও প্রায়শই। সম্ভাবনা ছিল ধরা খাবে, খায়নি। রেজাল্ট নেগেটিভ এসেছে। হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট পাঠাচ্ছে, বললেই চলে আসবে। বন্ধু ইমন, বন্ধুর চেয়ে আরো বেশি। একসঙ্গে এক ছাদের নিচে ময়মনসিংহে কাটিয়েছি ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬। তারপর দুজন দুই দিকে। ও সশস্ত্র আর আমি নিরস্ত্র চিকিৎসক। যোগাযোগটা অবশ্য প্রগাঢ়তরই হয়েছে। কদিন আগেই কভিড নিয়ে তিন-তিনটি বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা করেছি। প্রতিটিতেই আমরা দুজন কো-অথর। এর মধ্যে একটা তো ওর কাজের ডাটা নিয়েই করা। ঢাকা সিএমএইচের কভিড চিকিৎসায় যে সাফল্য, সেটাই বৈজ্ঞানিক জার্নালে ডকুমেন্টেশন করা। ইমনের এখনকার রাশভারি নাম লে. ক. ডা. ফায়জুল হক। আর আছে ডা. মুবিন। আমার একসময়ের ছাত্র আর এখন কলিগ। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে লিভারের সহকারী অধ্যাপক। ইমন আর মুবিনের অদ্ভুত মিল একটা জায়গায়। দুজনই ঠাণ্ডা, নির্ঝঞ্ঝাট, ছিমছাম। কিন্তু কভিড সামলানোয় দুজনেরই একেবারে ১৮০ ডিগ্রি অ্যাবাউট টার্ন। একজন ঢাকা সিএমএইচে কভিড ম্যানেজমেন্টের টপ পারফরমার আর অন্যজন কুর্মিটোলায়। আমার কপাল ভালো, ঘরে বসে আমি এদের দুজনেরই চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগটা পাচ্ছি। যখন খুশি ফোন দিচ্ছি, পরামর্শ নিচ্ছি আর বাসাটাকে হাসপাতাল বানিয়ে দিব্যি আছি। একটু নিশ্চিন্ত লাগছে। হেলালের কাছে ওষুধ চলে গেছে। প্রথম চালান। আমার ভাগের ফেভিপিরাভির আপাতত ভাগাভাগি করছি সবাই। ফারুক সাহেব লেমনের খেয়াল রাখছেন দূর থেকে, কাছে থেকে।
রাত ০২:৩০
মাত্রই ফোন রাখলেন আকবর ভাই। করোনার এই সময়টায় তাঁর সঙ্গে কথা বলাটা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। তিনি বরাবরই আর্লি রাইজার। আমি ইদানীং উল্টো। তিনি ঘুম থেকে উঠে ফোন ধরেন আর আমি ফোন রেখে ঘুমাতে যাই। ফোনে আড্ডা চলে নানা বিষয়ে, ভ‚ত-ভবিষ্যৎ, বিজ্ঞান-অবিজ্ঞান-দর্শন কী না! ইদানীং অবশ্য এই ফোনালাপগুলোও মোটামুটি করোনাময়ই। তিন-তিনটি পাবমেড পাবলিকেশন করেছি আমরা সদ্যই। এক্সেপটেড হয়েছে পাবমেড ইনডেক্সড জার্নালে আরো দুটি। পাইপলাইনে অপেক্ষমাণ কমপক্ষে আরো পাঁচটি। তবে মূল লক্ষ্য ন্যাসভ্যাক (সিআইজিবি ২০২০)-এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। ওষুধটি অনুমোদিত হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের চিকিৎসায়। এটির উদ্ভাবনে আকবর ভাইয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলাম আমিও। সম্প্রতি কভিডের চিকিৎসায় ন্যাসভ্যাককে পেটেন্ট করেছি আকবর ভাই আর আমি, সঙ্গে কিউবা আর জার্মানির কয়েকজন সহগবেষক। ভারতের যেমন হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, জাপানের ফেভিপিরাভির আর মার্কিনদের রেমডেসিভির, আমাদের গর্বের জায়গাটা হতে পারে এই ন্যাসভ্যাক। তবে কাজ করবে আশা করি ওগুলোর চেয়ে ঢের ভালো। এসব নিয়েই অসম বয়সী দুই বন্ধুর চলে নিত্যই ফোনালাপ। দুদিন ধরে অবশ্য চাপা টেনশনে আছেন আকবর ভাই। গলার স্বরে বুঝি। দুজন দুজনকে বুঝতে দিই না শুধু। কিছু লাগলে ফোন করতে বললেন, ফোন খোলা রাখছেন। সাত সাগর আর তেরো নদীর ওপারে জাপানে বসে কী করতে পারবেন জানি না, তবে জানি পারলে করতেন। করতেন যা পারতেন না তা-ও।
ভোর ০৪:৩০
লেখালেখি আর পড়াপড়িতে সময় কোন দিক দিয়ে চলে গেল, ফজরের আজানের শব্দ আসছে। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আÍজীবনী’ নিয়ে আবার বসেছি।
সকাল ১০:০০
জানালার বাইরে পরিচিত হৈচৈ। আবারও অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে হাজির আলমগীরের নেতৃত্বে ল্যাবএইডের ব্যাটালিয়ন। আম্মা, মুনমুন, মুনমুনের স্বামী জুয়েলসহ বাসার বাদবাকিদের স্যাম্পল কালেকশনে। আজকের আনুষ্ঠানিকতা গতকালের মতোই, তবে গতকাল এক দিনেই সাতজন পজিটিভ চলে আসায় আজ সবার ভেতর উত্তেজনাটা অনেক বেশি। আজ তদারকিতে মুনমুন, কারণ নুজহাতও আজ আমার মতোই ঘরবন্দি। আম্মা খুব একটা বুঝতে পারছেন বলে মনে হলো না। নাকি বুঝেছেন?
বিকেল ০৪:৩০
আলমগীরের ফোন। এখন আলমগীরের ফোন আমার কাছে অনেকের ফোনের চেয়েই অনেক বেশি দামি। এর মধ্যে টুকটাক চাউর হয়েছে আমার কভিড পজিটিভ। নুজহাতেরটা এখনো তেমন একটা মার্কেটে আসেনি। ফোন আসতে শুরু করেছে দু-চারটা করে। তালিকায় মাননীয় মন্ত্রীরাও আছেন। যেমন আছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন চাচা। চাচি অবশ্য গত রাতেই ফোন দিয়েছিলেন। খবর নিলেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানও। ফোন করেছিলেন রহিম ভাই, বিএসএমএমইউ হেপাটোলজি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনে আমার টুআইসি। জানতে চাইলেন ফোন ধরছি কি না। কেন, না? বললাম উত্তরে। বললেন, হেপাটোলজিস্টদের অনেকেরই মন খারাপ। তাঁকে ফোন দিচ্ছেন, জানতে চাইছেন আমি ফোন ধরছি কি না। শুনে বুকটা কেমন যেন খালি খালি লাগছে। আহা! বড্ড সুন্দর পৃথিবীটা। মনে পড়ছে, আব্বাকে শেষবার ল্যাবএইডে নিয়ে যাওয়ার সময় আধো অচেতনে কী যেন বলতে চাইছিলেন। বুঝতে পারছিলাম, যেতে চাইছিলেন না। কেমন কাঁদিয়ে-ভাসিয়ে ভোররাতে চলে গেলেন বদরউদ্দিন কামরান চাচা। সিলেটে আব্বার চলিশাটা হয়েছিল কামরান চাচার আয়োজনে, তাঁর বাসায়। আমি ঢাকা থেকে অতিথির মতো গিয়ে খেয়ে, মিলাদ পড়ে চলে এসেছিলাম। চাচার কুলখানিতে আমার যাওয়া হবে না। দুদিন আগে চলে গেছেন মোহাম্মদ নাসিমও। আর কখনো দেখবেন না, কিংবা দরাজ গলায় বলবেনও না, ‘কি স্বপ্নীল, খবর কী?’ আলমগীরের ফোন করার কারণটা আরেকটা দুঃসংবাদ দেওয়া। আরেকজন পজিটিভ। আমার ড্রাইভার সাবের। ওর রিপোর্টটা এক দিন পরে এলো। আমি এখন আরো ১৬ জনের রিপোর্টের অপেক্ষায়।
সন্ধ্যা ০৬:০০
মুনমুন ফোন করেছিল। আমার বোন। উত্তেজিত, বিষণœ, হতাশ। কাছেই একটা অ্যাপার্টমেন্টে জুয়েলকে নিয়ে দুজনের সংসার। ওর বাড়িওয়ালা টের পেয়ে গেছেন। টেরটা পাইয়েছেন আমাদেরই পরিচিত আরেকজন, একই অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা। বাড়িওয়ালার ভারি গোসসা হয়েছে। এ কেমন কথা? ভাই-ভাবি-ভাতিজা সবাই পজিটিভ! এ কেমন ভাড়াটিয়া? জানিয়ে গেছেন আমার সদ্য চুয়াত্তর পূর্ণ করা মাকে, যেন মুনমুন ভুলেও তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে আবার নিয়ে না তোলে। কভিড নেগেটিভ হলেও না। সাধে কি আলেকজান্ডার সিন্ধু থেকেই পাততাড়ি গুটিয়েছিলেন? হাড়ে হাড়ে টের পেলাম আরেকবার। আর ওই যে আমাদের পরিচিতজন, ব্রেকিং নিউজ ব্রেকার, তাঁর বেয়াইন, চারদলীয় জোট সরকারের এক প্রভাবশালী প্রতিমন্ত্রী আর এখনো জোটের বড় নেতার স্ত্রী, ওয়ান-ইলেভেনের পর যখন বঙ্গবন্ধুর প্রিজন সেলে আমার অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন, আদর্শের জায়গাটায় যোজন যোজনের ফারাক থাকা সত্তে¡ও বুঝতে দিইনি কখনোই। বয়সে তখন তরুণ ছিলাম। অধ্যাপকের আগে ছিল সহকারী। তার পরও চিকিৎসায় কোনো ত্র“টি রাখিনি। জোটের ওই বড় নেতার স্ত্রী আশা করি আজও সেটা স্বীকার করবেন। আর আমাদের যিনি পরিচিতজন, তিনিও কিন্তু কম বড় নন। যত দূর জানি, গত জাতীয় নির্বাচনে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় ধানের শীষের প্রতীকটা তাঁর জন্যই বরাদ্দ ছিল। বুঝি না, এই বড় মানুষগুলো হঠাৎ হঠাৎ কিভাবে যেন নিজেদের খুব বেশি ছোট করে ফেলেন।
রাত ১০:০০
বাসার প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল এসেছে। স্টিয়ারিংয়ে এখন সুকন্যা। বাবা-মা-ভাই সবাই চার দেয়ালে বন্দি। নিজের ঘরে বসে বাসার প্রশাসনটা ভালোই দেখভাল করছে বেচারি। বাপের জন্য ক্ল্যাগজেন ইনজেকশন আর সূর্যর জন্য আইসক্রিম তো দাদির ওষুধের বিলÑসব সামলাচ্ছে ভালোই। পাশাপাশি ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারও ভালোই করছে। বাবা-মা-ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ আর বাসার প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক নানা বিষয়ে পরামর্শের জন্য ভিডিও কল চলছে। একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্র“পও তৈরি করেছে মা-মেয়ে। নাম ‘উই শ্যাল ওভারকাম!’ বাসায় বেশ কিছু প্রশাসনিক বিধি-নিষেধও আরোপ করা হয়েছে। আমার করোনা রুমের জানালার লাগোয়া জায়গাটা ঘিরে দেওয়া হয়েছে তার দিয়ে। কেউ যাতে জানালার খুব কাছাকাছি চলে না আসে। আমাদের ওষুধপত্র, দৈনিক পত্রিকা আর প্রয়োজনীয় এটা-সেটা সাপ্লাইয়ের অন্যতম প্রধান রুট এই জানালাটাই। তবে মাস্ক-গ্লাভসের ব্যবহার বাধ্যতামূলক। বাসার পোর্চের নিচে গার্ড পোস্টে এসব পিপিই সামগ্রীর পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। সঙ্গে হ্যান্ড স্যানিটাইজারও। প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়ে প্রথম দিনই সুকন্যা ফিস্টের আয়োজন করেছে। ফুডপান্ডার বদান্যতায় হাজির স্টেক হাউসের টি-বোন স্টেক। ডিনারটা জম্পেশ হবে। সূর্যর খুশি দেখে কে! সঙ্গে আমারও।