খবর৭১ঃ রাজধানীতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন করার বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়নি বিশেষজ্ঞ কমিটি। করোনাসংক্রান্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরীক্ষার ফলাফলের ওপর আইসিটি মন্ত্রণালয় ম্যাপিং করছে। তারা রেড, ইয়েলো, গ্রিন জোন নির্ধারণ করছে। কোনো এলাকায় লাখে ৬০ জন বা তার অধিক সংক্রমিত লোক থাকলে সেই এলাকা রেড জোন। ৬০ জনের কম হলে ইয়েলো জোন এবং ৩ জনের কম থাকলে গ্রিন জোন। সেভাবেই কাজ চলছিল। কিন্তু এরই মধ্যে লকডাউন বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে জোন ছোট করতে বলা হল। এখন বিশেষজ্ঞরা সেই কাজই করে যাচ্ছেন। তাদের সুপারিশ পাওয়া গেলেই রাজধানীতে লকডাউন কার্যকর করা হবে।
যুগান্তরের সঙ্গে ভার্চুয়াল সাক্ষাৎকারে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক এসব কথা বলেন। ২২ জুন রাতে দেয়া এ সাক্ষাৎকারে দেশে চলমান করোনা পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন তিনি। বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কথাও জানান তিনি। পাশাপাশি দেশের স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর বিশদ আলোচনা করেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এ মুহূর্তে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল কিভাবে দেশকে করোনামুক্ত রাখা যায়। এজন্য যেখান থেকে যে ধরনের পরামর্শ আসছে সেগুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করছি। প্রধনমন্ত্রীর নির্দেশে দেশকে কোভিড মুক্ত করতে সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, প্রথমে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চীন থেকে ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চীন লকডাউন করলে স্পেন, ব্রিটেন ও আমেরিকা তাদের সংক্রমিত এলাকাগুলো লকডাউন করেনি। ফলে সেখানে ব্যাপক হারে মানুষ আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করতে শুরু করেন। আমরা প্রথমে আক্রান্ত দেশগুলোর উড়োজাহাজ আসা-যাওয়া বন্ধ করতে পারিনি। কারণ হচ্ছে- প্রবাসে কর্মরত বিপুলসংখ্যক শ্রমিক ওই সময় ফ্লাইটে আসছিলেন। তাদের কথা বিবেচনা করেই তখন ফ্লাইট বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
জাহিদ মালেক বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করল। এপ্রিলে দেশে করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার। কিন্তু দেশের মানুষ সাধারণ ছুটির সময় বাড়িতে না থেকে ইচ্ছামতো ঘোরাফেরা করেছে। ফলে মে মাসে এটি ৫০ হাজারে উন্নীত হয়। কঠোরতা না থাকায় এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা না থাকায় এসময় সবাই ঈদের বাজার করতে শুর করল। তারা স্বাস্থ্য বিধি মানল না। এরই মধ্যে একবার গার্মেন্ট খোলা হল, আবার বন্ধ করা হল। ঈদ উপলক্ষে মানুষ যেভাবে গাদাগাদি করে ফেরি পারাপার হল, সেসব কারণেই এভাবে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করল। এসব কারণে ওই সময় এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ সাধারণ ছুটির পর দেশের ১৫ শতাংশ দরিদ্র মানুষের জীবন-জীবিকার কথা চিন্তা করে লকডাউন শিথিল করা হল। কিন্তু পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে করণীয় নির্ধারণে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সচিবসহ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে যাই। সামগ্রিক পরিস্থিতি অবহিত করি। কিন্তু গোটা দেশ লকডাউনের প্রস্তাব দেইনি। তবে যে পাঁচটি শহর (ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদী) হটস্পট সেই শহরগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা- সে ব্যাপারে নির্দেশনা চাওয়া হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের যেখানেই সংক্রমণ বেড়েছে, সেখানেই লকডাউন করেছে, সব ধরনের মুভমেন্ট বন্ধ করে দিয়েছে, ভালো ফল পেয়েছে। সেসব দেশে এখন স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কিন্তু লকডাউন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একক কোনো সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামগ্রিক তথ্য-উপাত্ত দিতে পারে, কিন্তু বাস্তবায়ন করবে স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বর্তমানে যে কার্যক্রম চলছে সেটির সঙ্গে এসব মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, আইসিটি মন্ত্রণালয় জড়িত রয়েছে। সম্মিলিতভাবে সব সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হয়।
চায়না থেকে আসা মেডিকেল টিম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারা বলে গেছেন, র্যাপিড টেস্টের প্রতি তারা গুরুত্ব দেননি। সেখানে অনেক ভুল হওয়ার শঙ্কা থাকে। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও র্যাপিড টেস্টের অনুমোদন দেয়নি। তাই আমরা এখনও র্যাপিড টেস্টের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করিনি। তারা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখে গেছেন। এ বিষয়ে তারা পরামর্শ দ্রুতই প্রদান করবেন। তাছাড়া চায়নায় করোনার টিকা আবিষ্কারের পথে অনেকটা এগিয়েছে। তারা আমাদের কথা দিয়েছেন আমাদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেই টিকা প্রদান করবেন।
দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে তিনি আরও বলেন, আমাদের কিছু ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন ছিল। সেগুলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন অক্সিজেন সিলিন্ডারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আমরা দশ হাজার সিলিন্ডার আমদানি করছি। প্রয়োজনে আরও করা হবে।
সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরেজ ডিপার্টমেন্টের (সিএমএসডি) সাম্প্রতিক কেনাকাটায় অনিয়ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেখানকার বিগত পরিচালক ৯শ’ কোটি টাকার কেনাকাটা করেছেন। কিন্তু এখনও কেনাকাটার কোনো বিল মন্ত্রণালয়ে পাঠাননি। যদি কোনো ঠিকাদার নিয়ম না মানে, ঠিকমতো সরঞ্জাম সরবরাহ না করে, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে।
তিনি জানান, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় ডেডিকেটেড করেছি। এর আগে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের আধুনিকায়ন ও এক্সটেনশনের ব্যবস্থা করেছি। ১০ হাজার ডাক্তার ও ১৫ হাজার নার্স নিয়োগের ফাইল নিজে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন করিয়েছি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর টানা ১০ বছরের শাসনামলে স্বাস্থ্য খাতে যে উন্নয়ন হয়েছে, তা বিগত ৫০ বছরেও হয়নি। তিনি আরও বলেন, সারা দেশে সব জেলা হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন ও ভেন্টিলেটর সংযুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এমআরআই, সিটিস্ক্যানসহ ১২শ’ কোটি টাকার ভারি যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। সেগুলো বাতিল না করে মেরামতের নির্দেশ দিয়েছি। নতুন মেশিন কেনার ক্ষেত্রে ৮ বছরের বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদানের শর্ত প্রদান করেছি। এ শর্ত যারা মানতে পারবেন না, তাদের কাছ থেকে যন্ত্রপাতি নেয়া হবে না। তিনি বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে আরও অনেক কাজ করার আছে। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের দেড় বছর হতে চলেছে। এর মধ্যে এক বছর কাটল ডেঙ্গু মোকাবেলায় আর ৬ মাস যাচ্ছে করোনা নিয়ে। সব প্রতিকূলতা সামাল দিয়ে একটি জনবান্ধব স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দিতে কাজ করতে হবে।