খবর৭১ঃ কারোনাকালে চলতি ব্যয়ের টাকার জোগান দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘রাজকোষের’ ওপর সরকারের নির্ভরতা বেড়েছে। অর্থনীতির দুর্যোগের এই সময়ে মানুষের জীবন-জীবিকার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ‘দুই হাতে’ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার- যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। গত এক বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার প্রায় ৪৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আগে কখনোই এত বেশি ঋণ নেয়নি। এর আগের বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার কোনো ঋণই নেয়নি। বরং আগের নেয়া ঋণের ৬০৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেছিল।
সূত্র জানায়, করোনা ভাইরাসের প্রভাবে প্রায় তিন মাস ধরে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় সরকারের রাজস্ব আয় আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। এছাড়া কমেছে অন্যান্য খাতের আয়ের পরিমাণও। অন্যদিকে করোনার প্রভাব মোকাবেলা করতে বেড়েছে ব্যয়ের পরিমাণ। আয় কম থাকায় বাড়তি ব্যয় মেটাতে সরকারকে ঋণ নিতে হচ্ছে। ঋণের জন্য সরকার সব সময়ই বাণিজ্যিক ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং খাতকে অগ্রাধিকার দিলেও আর্থিক দুরবস্থার কারণে এখন দিতে পারছে না। ফলে বাধ্য হয়েই সরকারকে বাড়তি ঋণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ‘হাত পাততে’ হচ্ছে।
দেশের শীর্ষ স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকাকে বলা হয় ‘হাই পাওয়ার্ড মানি বা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাকা’- যা বাজারে এসে দ্বিগুণ থেকে আড়াইগুণ টাকার সৃষ্টি করে। এতে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে যাবে। এসব টাকা উৎপাদনশীল খাতে গেলে ভালো হতো। কিন্তু এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণের টাকা দিয়ে চলতি ব্যয় মেটানো হচ্ছে। অর্থাৎ বেশির ভাগ টাকাই যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। এতে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর সঙ্গে উৎপাদনের সমন্বয় রেখে উৎপাদন বাড়ছে না। এ কারণে পরবর্তীতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকায় হাত যত কম দেয়া যায় ততই মঙ্গল। কেননা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা বাজারে এলে তা মূল্যস্ফীতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। তবে বর্তমানে করোনার প্রভাব মোকাবেলা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা নেয়া যেতে পারে। অর্থনীতিকে দ্রুত স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে এনে সেগুলো দ্রুত সমন্বয় করতে হবে। তা না হলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতা দেখা দেবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, গত কয়েকটি সরকারই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মোটা অংকের ঋণ নিয়েছে। অথচ এ বিষয়ে বাজেটে বা মুদ্রানীতিতে কোনো উল্লেখ নেই। সরকার বিপদে পড়লে বা যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া একটি রুটিন মাফিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য বাজেটেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার একটি প্রাক্কলন থাকতে পারে। এতে দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, গত বছরের ১৩ মে পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ২৩ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকায়। ওই এক বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ৪৮ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ১৩ মে পর্যন্ত সময়ে সরকার ঋণ নিয়েছে ৩৭ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার কোনো নতুন ঋণ নেয়নি। বরং আগের নেয়া ঋণের মধ্যে পরিশোধ করেছিল ৬০৮ কোটি টাকা। এছাড়া করোনার প্রভাব মোকাবেলায় ৬টি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৫০ কোটি টাকার জোগান দিচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে।
এর বাইরে আলোচ্য সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ২১ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে নিজ উদ্যোগে টাকার সৃষ্টি করতে পারে। সে ক্ষমতা বলেই তারা বিভিন্ন তহবিল বা প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে কিংবা সরকারকে ঋণের জোগান দিতে পারে।
সূত্র জানায়, রাজস্ব আয়ের অর্থ থেকে সরকার চলতি ব্যয় মেটায়। করোনার প্রভাবে এপ্রিল পর্যন্ত রাজস্ব আয়ে ঘাটতি রয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। এ ঘাটতির টাকার জোগান দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংক, নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাত ও সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেও সরকার ঋণ নিচ্ছে। কিন্তু ঋণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ওইসব খাত থেকে সব ঋণের জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে হাত পেতেছে সরকার।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সরকারের আয়ের খাতে ঘাটতি দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী টাকার জোগান দিয়ে দেয়। আয় বাড়লে সেগুলো সমন্বয় করে। আয় কম হওয়ার কারণে সরকারের হিসাবে ঘাটতি থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকায় ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ হয়ে গেলে ট্রেজারি বিল ইস্যু করে। এভাবে ঋণের অংক শত কোটি টাকা অতিক্রম হলেই ট্রেজারি বিল ইস্যু করে। পরে এগুলো বাণিজ্যিক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রি করে এসব অর্থকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ঋণে রূপান্তর করে। বর্তমানে করোনার প্রভাব মোকাবেলায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তারা সরকারকে প্রয়োজন অনুযায়ী টাকার জোগান দিতে পারছে না।