খবর৭১ঃ চলতি জুনে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর হার গুণোত্তর ধারায় (এক্সপোনেনশিয়াল) বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন নেদারল্যান্ডসের গ্রনিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। তিন মাসে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
প্রবাসী বাংলাদেশি গবেষকদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা মে মাসের শেষদিকের আগ পর্যন্ত এক্সপোনেনশিয়ালি (গুণোত্তর ধারায়) উপরের দিকে ওঠার প্রমাণ নেই। কোভিড-১৯ পজিটিভের গ্রাফ যেমন উপরের দিকে ওঠেনি, তেমনি করোনা উপসর্গে ও কোভিড-১৯ পজিটিভে মোট মৃত্যুর গ্রাফটি সেভাবে খাড়া উপরের দিকে ওঠেনি। ঠিক যেমনটি ইতালি, স্পেন, বা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু, উভয় গ্রাফের শেষ প্রান্তের দিকে দেখা যাচ্ছে, রেখাগুলো বেঁকে কিছুটা উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে, যা একটি এক্সপোনেনশিয়াল কার্ভের শুরুর পর্যায়কে নির্দেশ করে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশিষ্ট রোগতত্ত্ববিদ এবং রোগতত্ত্ব রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের দেশে এখন মাঝারি গতিতে করোনা সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। সংক্রমণের হার ১ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে যদি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে যে কোনো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় হঠাৎ গুণোত্তর ধারায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেটা জুনেও হতে পারে অথবা জুলাইয়েও হতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে প্রথম মৃত্যুর পর তিন মাস পার হওয়ার আগেই সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে।
বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আরও ৩৭ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ সংখ্যা বেড়ে ১০১২ জনে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল ৮ মার্চ। এর ১০ দিনের মাথায় প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। এর এক মাস পর ২০ এপ্রিল মৃতের সংখ্যা ১০০ ছাড়ায় এবং এর এক মাস ৫ দিন পর মৃতের সংখ্যা ৫০০ অতিক্রম করে। একই হিসাবে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা প্রথম ৫০০ জন ছাড়াতে সময় লেগেছিল ৬৭ দিন (২ মাস ৭ দিন)। আর পরের ৫০০ জনের মৃত্যু ঘটেছে মাত্র ১৬ দিনে।
গবেষণায় হাসপাতালগুলোর করোনা বা আইসোলেশন ওয়ার্ডের চিকিৎসা ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, বিভিন্ন হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসক, নার্সের সংকট, রোগীদের কাছে তাদের নিয়মিত না যাওয়া, গেলেও ঠিকভাবে না দেখা বা অনেক দূর থেকে চিকিৎসা দেয়া, অনেক ক্ষেত্রে কয়েকদিনের মাঝেও চিকিৎসকের দেখা না পাওয়া, সাধারণ সমস্যায় নার্সদের সহযোগিতা না পাওয়া, ডাকলেও চিকিৎসক-নার্স রোগীর কাছে না আসা, রোগীদের খাবার ওয়ার্ডের দরজার সামনে রেখে যাওয়া- এরকম নানা অভিযোগের তথ্য রয়েছে। এ ছাড়া আইসিইউর অপ্রতুলতা, অক্সিজেন সরবরাহের অপ্রতুলতা।
কোনো কোনো করোনা বিশেষায়িত হাসপাতালে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। যেখানে একেকটি অক্সিজেন পোর্ট থেকে ৪-৫ জন রোগী পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করেন। এমনকি রোগীর আত্মীয়স্বজনের অনুরোধের পর অক্সিজেন সিলিন্ডার মিললেও সেটি রোগীর নাকে-মুখে স্থাপনে কোনো নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মী এগিয়ে আসেন না। হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের চিকিৎসা প্রদানে অনীহা বা ভীতির পেছনে কারণ হিসেবে পর্যাপ্ত ও যথাযথ মানসম্মত ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী প্রধানত দায়ী বলে মনে করেন গবেষকরা।
গবেষণায় বলা হয়, একইভাবে এ মহামারীর সময়টিতে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট ব্যাপকভাবে উন্মোচিত হয়েছে। করোনা ইনফো ওয়েবসাইটের তথ্যের বরাত দিয়ে তারা বলেন, বিভিন্ন বিভাগে কত কমসংখ্যক চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে করোনা চিকিৎসা করানো যায়, সে চেষ্টা করা হয়েছে। শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে নিয়োজিত চিকিৎসকের সংখ্যা ১০০-র বেশি। শুধু রাজশাহী বিভাগে নার্সের সংখ্যা ১০০-র বেশি। অন্যদিকে পুরো ময়মনসিংহ বিভাগে চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা ২৫-এরও কম। সারা দেশে মোট ৫৯৫ জন চিকিৎসক ও ৫৪৬ জন নার্স দিয়ে করোনা মহামারী মোকাবেলা করা হচ্ছে।
গবেষণায় আরও বলা হয়, ৮ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত করোনা উপসর্গে মারা গেছেন ৯০০ জন। করোনা উপসর্গে মার্চে মারা গেছেন ৭২ জন, এপ্রিলে ৩১৯ জন এবং মে মাসে ৫০৯ জন। কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়ে মার্চে (১৮-৩১ মার্চ পর্যন্ত) মারা গেছেন ৫ জন, এপ্রিলে ১৬৩ জন এবং মে মাসে ৪৮২ জন। কোভিড-১৯ উপসর্গে মৃত্যুগুলোর ক্ষেত্রে জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্টের লক্ষণ থাকলেই শুধু তথ্যগুলো সংকলিত করা হয়েছে। এর বাইরে ৩৯০টি ক্ষেত্রে আলাদাভাবে লক্ষণ উল্লেখ না থাকলেও করোনাভাইরাসের উপসর্গে মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। বাকি ৫০৬টি মৃত্যুর ঘটনায় ১৮টি লক্ষণের তথ্য পাওয়া গেছে। জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টের বাইরেও যেসব লক্ষণ দেখা গেছে সেগুলো হল : সর্দি, ডায়রিয়া, গলাব্যথা, ঠাণ্ডা, বুকব্যথা, বমি, মাথাব্যথা, শরীরে ব্যথা, খিঁচুনি, পেটে ব্যথা, গিঁটে ব্যথা, উচ্চরক্তচাপ, আমাশয় ও কানে ব্যথা, নাক দিয়ে রক্তপাত।