ঝালকাঠির রায় বাড়ির ছয় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ইতিহাসে

0
689
ঝালকাঠির রায় বাড়ির ছয় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ইতিহাসে
ছবিঃ রতন আচার্য্য, ঝালকাঠি প্রতিনিধি।

খবর৭১ঃ

রতন আচার্য্য, ঝালকাঠি প্রতিনিধিঃ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকবাহিনী নিরীহ বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অসংখ্য মানুষকে সেদিন তারা হত্যা করে নারকীয় কায়দায়। তখন সারা দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় শুরু হলো। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে সাত কোটি নিরস্ত্র মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছিল সেদিন।

তাদের যতটুকু সম্বল ছিল তাই নিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করল। দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল যুদ্ধ। দেশের প্রতি ভালোবাসা ও কর্তব্যবোধে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ শিক্ষিত-অশিক্ষিত, কর্মজীবী-বেকার, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের মানুষ আত্মপরিচয় ও মর্যাদার প্রশ্নে দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। যার যার মতো করে মুক্তিসংগ্রামে যোগ দিল। অসংখ্য পরিবার ‘হয় মন্ত্রের সাধন, নয় শরীর পাতন’ এই মহামন্ত্র নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। এদের মধ্যে বর্তমান বৃহত্তর বরিশালের ঝালকাঠি জেলার কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী রুনশী গ্রামের রায় পরিবার একটি। স্বর্গীয় সুশীল কুমার রায় ও মাতা শোভা রায়ের সুযোগ্য ছয় সন্তান। তারা হলেন, অঞ্জলি রায়, সন্ধ্যা রায়, শ্যামল রায়, মনিকা রায়, সুদীপ্তা রায় ও কলম রায়। ৯ নম্বর সেক্টরে অঞ্জলি রায়, শ্যামল রায় ও সুদীপ্তা ও ১১ নম্বর সেক্টরে মনিকা রায়, সন্ধ্যা রায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কিশোর কমল রায় ৯ নম্বরসহ মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটিতে খবর পৌঁছে দিতেন। এই ছয় ভাইবোন স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধের মাঠে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন।

মূলত সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আদর্শে উদবুদ্ধ বাবা মায়ের অনুপ্রেরণায়ই বাংলাদেশের গর্ব এই ছয় ভাইবোন যুদ্ধে নেমেছিলেন। পরিবারের বড় মেয়ে অঞ্জলি রায়। তিনি ১৯৭১ সালে ঝালকাঠির শিরযুগ আজিমুন্নেছা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অঞ্জলি রায় ২০১৫ সালে ২৫ নভেম্বর পরলোকগমন করেন। তাঁর একমাত্র মেধাবী কন্যা সুমনা গুপ্তা। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়ালেখা শেষে করে ২০১০ সালে নিজ বিভাগেই প্রভাষক পদে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তিনি কবিতা, ছড়া ও কলাম লেখেন জাতীয় দৈনিক ও অনলাইনে। গান চর্চাও করেন। সুমনা গুপ্তা মানবিক মনের শিল্পসাহিত্যের অনুরাগী ও দেশপ্রেমী একজন মানুষ। পরিবারের সেজ মেয়ে অধ্যাপক সন্ধ্যা রায়। ভারত এবং বাংলাদেশের সাহিত্যের অঙ্গনে সুপরিচিত। বরিশালের সরকারি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তিনি ছিলেন বিভাগীয় প্রধান। বর্তমানে ভারতে অবসর জীবন যাপন করছেন। তার স্বামী দুই বাংলার প্রখ্যাত সাহিত্যিক মিহির সেনগুপ্ত। তিনি তার লেখার জন্য ২০১৩ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আনন্দ লাভ করেন। সন্ধ্যা রায়ের দুই সন্তান। বৈদেহী সেনগুপ্ত ও কস্তুরি সেনগুপ্ত। বৈদেহী সেনগুপ্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লিংগুইস্টিক এ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে কলকাতা মিউজিয়ামে উচ্চপদে কর্মরত। দ্বিতীয় সন্তান শ্যামল রায়। তিতাস গ্যাসের অতি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। শ্যামল রায় গত মাসের ২৭ মে, ২০২০ সালে পরলোক গমন করেন। তাঁর দুই মেয়ে শম্পা রায় ও প্রিয়াঙ্কা রায়। বড় মেয়ে প্রিয়াঙ্কা ইংরেজিতে মাস্টার্স আর ছোট মেয়ে শম্পা আইনে মাস্টার্স। চতুর্থ সন্তান মনিকা রায়। স্বাধীনতার পর মনিকা রায় ভারতে চলে যান। পড়াশোনার জন্য। ব্যবসায় পরিচিতি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন।

পরবর্তীতে ভারতীয় নাগরিককে বিয়ে করে সেখানেই স্থায়ী ভাবে বসবাস করেন। তবে নাড়ির টানে বছরে একবার বাংলাদেশে নিজ জন্মভূমিতে আসেন। বিবাহ সূত্রে তিনি এখন ভারতীয় নাগরিক। তার একমাত্র সন্তান সৌম্য পাল তুখোড় মেধাবী ছাত্র। বর্তমানে ভারতের একটি ব্যাংকে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা। পঞ্চম সন্তান ছোট মেয়ে সুদীপ্তা রায়। তিনি ইংরেজিতে মাস্টার্স ও বিএড ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তার শিক্ষা জীবন ভারত বাংলাদেশ দুই দেশেই চলে সমান তালে। খুব ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যের জগতে তিনি দাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন। জাতীয় দৈনিকে তার নিয়মিত লেখা প্রকাশ হয়। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৮টি। সুদীপ্তা ঘোষ মাসিক জুডস নিউজ এক্সিকিউটিভ এডিটর ছিলেন। তিনি ভালো আবৃত্তিও কারেন। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। সুদীপ্তা রায়ের একমাত্র সন্তান ডা. শংখময় ঘোষ। তিনি পেশায় ডাক্তার হলেও উচ্চমানের সংগীত শিল্পী। সুদীপ্তা ঘোষের স্বামী সুনীল ঘোষ রবীন্দ্র সংগীতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ গ্রেডের শিল্পী। রেডিও ও টেলিভিশন এর ক্যাজুয়াল সংগীত পরিচালক ও রবিচ্ছায়ার সভাপতি। ষষ্ঠ সন্তান কমল রায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তার বয়স তখন ১২ বছর। বর্তমানে তিনি ব্যবসাসী। কলম রায় ঝালকাঠির রুনশী গ্রামের থাকেন। তার মেয়ে কলি। তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে থেকে পালিতে ফার্স্ট ক্লাস দ্বিতীয়। কলি কবিতা লেখেন ও গান চর্চাও করেন। ছোট মেয়ে প্রাপ্তি এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছেন। বর্তমানে বরিশাল অমৃতলাল কলেজে একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। তিনি ভালো ছবি আঁকেন।

বাংলাদেশের সূর্যসন্তান রায় পরিবারের এই ছয় জনের পারিবারিক অবস্থান উল্লেখ করলাম। ১৯৭১ সালে দেশ মাকে ভালো বেসেছিলেন বলেই মাকে শত্রুমুক্ত করতে কপালে লাল শালু বেঁধে কাঁধে বন্ধুক, গ্রেনেড নিয়ে বরিশাল অঞ্চলে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যুদ্ধের ৯ মাসে মাঝে কোনো না কোনো অপারেশনে দেখা হতো ভাই বোনেদের সাথে। মেজ ভাই প্রয়াত শ্যামল রায় ও প্রয়াত অঞ্জলি রায় এত কিছুর মধ্যেও পরিবারের খোঁজ নিতেন নিয়ম করে। সেজ ভাই কমল রায়কে বলা যায় শিশু মুক্তিযোদ্ধা। কারণ তিনি ওই সময় দাদা দিদিদের গোপন ক্যাম্পে ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন মিলিটারিদের, রাজাকারের গতিবিধি। দীর্ঘ নয় মাস এক ভয়ানক রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের পরিণতি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদদের ও সম্ভ্রম হারা দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রমহানী হয়েছেন। যেসব মুক্তিকামী যোদ্ধা বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে আমাদের একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন। সেইসব মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান।

এমন একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান শ্রদ্ধেয় সুদীপ্তা ঘোষের কাছে থেকেই মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনা ও পরবর্তী প্রজন্মের কথা জানতে পারলাম। রয়ে গেছে আরও অজানা কথা। তাই মনে হলো মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদানের কথা সবার জানা দরকার। এ প্রজন্ম হয়তো অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা জানে না। আসলে জানা দরকার। মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা জানতে পারলেই হয়তো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ভিত্তিতে দেশ গড়তে এগিয়ে আসবে তারা। এই রায় পরিবারের ছয় সন্তান দেশকে ভালোবাসে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। যাদের দ্বারা দেশ স্বাধীন হয়েছে।

সেই স্বাধীন বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসাবে তাদের পরিবারের সবার মঙ্গল কামনা করছি। বাংলাদেশের ইতিহাসে রায় পরিবারের মুক্তিযুদ্ধের অবদানের স্মৃতি অমলিন থাকবে। যারা আমাদের এনে দিয়েছেন একটি স্বাধীন দেশ, জাতীয় সংগীত আর জাতীয় পতাকা তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা নিবেদনে বর্তমান প্রজন্মসহ আগামী প্রজন্মও অব্যাহত রাখবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধারাবাহিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের প্রতি যথার্থ সম্মানে জাগিয়ে তুলবে পরবর্তী প্রজন্মকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here