করোনাকালের অস্বস্তিকর আরেকটি দিন

0
606
ছাতকে করোনা ভাইরাসে ডাক্তারসহ নতুন আক্রান্ত ১৬

খবর৭১ঃ গতকাল যখন লেখাটি লিখছি বাংলাদেশ তখন কিছু অস্বস্তিকর তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে ব্যস্ত গতকাল একদিনে এদেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক ১৯ জন কোভিড১৯ রোগী মৃত্যুবরণ করেছেন নিয়ে গতকাল পর্যন্ত দেশে সর্বমোট ২৬৯ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেন এর আগ পর্যন্ত কোনো একটি দেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশী কোভিড১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দ্বিতীয় স্থানে গতকাল আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশীদের মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে পেছনে ফেললাম পাশাপাশি গতকাল দেশে কোভিড১৯ রোগটি ধরা পড়েছে আরো ,১৬২ জনের শরীরে নিয়ে এদেশে সর্বমোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১৭,৮২২ জনে দুটিও নতুন রেকর্ড আমাদের জন্য

তো গেল হতাশার দিকগুলো। আশার কথা হলো গতকাল দেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৪০টি পিসিআর ল্যাবে সার্সকোভ ভাইরাসটি শনাক্তের কাজ চলেছে। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশে একদিনে রেকর্ড সংখ্যক ,৯০০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। আরেকটি ভাল খবর গতকাল আরো ২১৪ জন কোভিড১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি এদেশে সুস্থ হয়েছেন। ফলে রোগে সুস্থ হওয়ার মোট সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ালো ,৩৬১ জনে

গতপরশু দেশের জনপ্রিয় একটি অনলাইন পোর্টালের দুটো খবর বেশ আলোড়ন তুলেছে। একটি রিপোর্ট যেখানে তারা ওয়ার্ল্ডোমিটারের রেফারেন্স দিয়ে দেখিয়েছেন যে দেশে প্রথম কোভিড১৯ রোগীটি শনাক্ত হওয়ার ৬০ দিনের মাথায় মোট আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ আছে দ্বিতীয় স্থানে। সময় আমাদের চেয়ে এগিয়ে ছিল শুধু যুক্তরাষ্ট্র আর পিছিয়ে ছিল এমনকি যুক্তরাজ্য রাশিয়াও। পাশাপাশি খবরটিতে এদেশে কোভিড১৯ আক্রান্তদের সুস্থ হয়ে ওঠার ধীরগতিতেও শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। কাজেই গভীর রাতে দেশের একটি অন্যতম প্রধান টিভি চ্যানেলের খুবই জনপ্রিয় টকশোর অনেকখানি জুড়ে যখন এই বিষয়টি নিয়েই আলোচনা আমি তাতে খুব বেশি অবাক হইনি

একই দিনে একই অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে সরকারি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন দায়িত্বশীল সম্পাদকের লেখা একটি তথ্যবহুল প্রবন্ধও। জানতে পারছি কোভিডের ক্লোজড কেস বিবেচনায় বাংলাদেশে সুস্থ হয়ে ওঠা আর মৃত্যুর হার যথাক্রমে ৯২% আর % অন্যদিকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই সংখ্যা দুটি যথাক্রমে ৮৪% ১৬% আর যদি কারেন্ট কেস বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে কোভিড১৯ আক্রান্ত রোগীদের সুস্থতার হার ১৮.% আর মৃত্যুর হার .% বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কারেন্ট কেসে কোভিড১৯ মৃত্যুর হার % অর্থাৎ ক্লোজড এবং কারেন্ট এই দুই ধরনের কেসের ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অবস্থানটা সুস্থ হয়ে ওঠা আর মৃত্যু এই দুই ক্ষেত্রেই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্বস্তিদায়ক

করোনাকালের অস্বস্তিকর আরেকটি দিন
লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল), চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ। অর্থ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।

পরস্পরবিরোধী অথচ বাস্তব এসব তথ্যউপাত্ত আমাদের বিভ্রান্তিটা আরো বাড়াচ্ছে বৈ কমাচ্ছে না। আমি বলি কি, এতসব সংখ্যাটংখ্যা ভুলে যান। এদেশে কোভিডের দুটো বিপরীতমুখী ধারা এখন স্পষ্ট। বাড়ছে রোগী এবং মৃত্যুর সংখ্যা যা অবশ্যই হতাশা আর শঙ্কার আর অন্যদিকে বাড়ছে নমুনা পরীক্ষা আর সুস্থ মানুষের সংখ্যা যা দেখাচ্ছে অন্ধকারে আলোর দিশা

আমাদের একটা প্রধান দুশ্চিন্তার জায়গা এদেশে টেস্ট কম হচ্ছে। যদি আরো বেশি টেস্ট হতো তাহলে হয়ত রোগীতে রোগীতে সয়লাব হয়ে যেত পুরো দেশ। ব্যাপারটা কিন্তু একদমই সেরকম না। টেস্ট এখনও প্রয়োজনের তুলনায় কম হচ্ছে। কাজেই কেউ যদি সার্সকোভ সংক্রমণের পরীক্ষা করতে চান, তার জন্য কঠিন হচ্ছে টেস্ট করানোটাও। এখন শুধু তারাই কষ্ট করে পরীক্ষা করতে যাচ্ছেন যাদের কিছু হলেও লক্ষণ দেখা দিচ্ছে এবং সেটা বাড়ছে। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষও চাচ্ছেন শুধু তাদেরই পরীক্ষা করতে যাদের রোগের লক্ষণ শুনে বোঝা যাচ্ছে যে তারা সম্ভবত কোভিড১৯ আক্রান্ত

যদি আজকে এদেশে সাত হাজারের জায়গায় চৌদ্দ হাজার কিংবা আটাশ হাজার মানুষের পরীক্ষা করা যেত তাহলেরোগের লক্ষণ নেই কিন্তু সন্দেহ করছেন যে রোগটি আছে ধরনের মানুষগুলোই পরীক্ষা করাতে আসতেন বেশিবেশি এবং তাদের পরীক্ষা করানোও হতো বেশিবেশি। কাজেই তখন পরীক্ষা অনেক বেশি হলেও রোগীর সংখ্যা কিন্তু এগারোশর জায়গায় চৌদ্দ কিংবা পনের হতো, এগারো হাজার না। যে ষাটতম দিনে আক্রান্তের হিসাবে আমরা সিলভার মেডেল পাচ্ছি, তার কারণটাও এটাই

ষাটতম দিনে এসেও আমাদের পিসিআর সক্ষমতা সীমিত। ফলে আমরা ক্লিনিক্যালি অনেক বেশি নিশ্চিত না হয়ে পরীক্ষা করাচ্ছি না, যে কাজটি হয়তো করতে পারছে অনেক দেশই। মনে আছে ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্র সরকার প্রধানদের ভিডিও কনফারেন্সটির কথা? সেদিন বাংলাদেশে পিসিআর ল্যাব ছিল একটি আর ভারতে ষাটটি। আজ যখন আমাদের পিসিআর ল্যাব চল্লিশটি, ভারত তখন য়ের ঘর পেরিয়েছে অনেক আগেই। প্রাসঙ্গিকভাবেই যখন পিসিআরএর কথা উঠল তখন পিসিআর ল্যাব নিয়ে আরো দুটো কথা না বললেই নয়। একমাস আগেও এদেশে সরকারি পিসিআর ল্যাব ছিল একটি আজ যা চল্লিশ ছুইছুই। পাইপলাইনে আছে আরো পনেরটি। এটি সোজা কথা নয়, কারণ সারা বিশ্বে সহসা চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এখন আর পয়সা থাকলেই পিসিআর মেশিন বিশ্ব বাজারে অত সহজে কিনতে পাওয়া যায় না। কাজেই এক মাসে এক্ষেত্রে সরকারের অর্জন অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে এটাও সত্যি যে এই ল্যাবগুলোর সক্ষমতা এখনও আমরা পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করতে পারছি না। তার মূল কারণ পিসিআর মেশিন পরিচালনায় দক্ষ জনশক্তির অভাব। তবে এক্ষেত্রেও সরকার প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পত্রিকান্তরে জানতে পেরেছি সরকার পিসিআর পরীক্ষার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো এবং ননমেডিকেল পোস্টগ্র্যাজুয়েটদেরকেও কাজে সম্পৃক্ত করতে শুরু করেছে। এমনকি এক জেলার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য জেলায় সরকারি মেডিকেল কলেজে পিসিআর মেশিন নিয়ে যাওয়ার মত ঘটনাও ঘটছে। পিসিআর ল্যাব স্থাপনে এগিয়ে এসেছেন দেশের মাননীয় মন্ত্রীও। সব কিছুই আশা জাগানিয়া। আমাদের টেস্ট করার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে নিঃসন্দেহে, কিন্তু এই মুহূর্তে পিসিআর ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করারও কোনো সুযোগ নেই। পৃথিবীর কোথাও কেউ তা করেনি। আর যারা করেছিল তারা অনুশোচনা করে সে পথ থেকে সরে এসেছে

যাহোক মূল আলোচনায় ফিরে আসি। কোভিড১৯ মোকাবেলায় আমাদের সাফল্য মোটা দাগে দুটি। একটি, পর্যায়ক্রমে টেস্টের সংখ্যা বৃদ্ধিতে আর অন্যটি আরো বেশি মানুষকে সুস্থ করে তোলায়। আর এই দুটি সাফল্যের জন্য শতকরা শতভাগ কৃতিত্ব কিন্তু সরকারেরই। কারণ কোভিড১৯ ডায়াগনোসিস ট্রিটমেন্টে আজকের দিনটি পর্যন্ত এদেশে বেসরকারি খাতের অবদান শূন্য শতাংশের চেয়ে সামান্য বেশি

আর এক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা যদি দেখেন সেটি মোটা দাগে একটি, আর তা হলো কোভিড১৯এর কার্ভটিকে আমরা এখনো ধরাশায়ী করতে পারিনি। এখনও আমাদের দেশে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এজন্য যে কেউই সরকারকেই দায়ী করবেন বিনা বাক্য ব্যয়ে। আমি অবশ্য সবিনয়ে দ্বিমত পোষণ করি। আমার বরং বিশ্বাস সরকারি কিছু উদ্যোগের কারণেই কোভিড নামক দৈত্যটি এখনও ক্রমশঃ বড় হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা লাফিয়েলাফিয়ে বাড়ছে না। বাংলাদেশে পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় অনেক আগেই লকডাউন করা হয়েছিল। মার্চ দেশে প্রথমবারের মত কোভিড১৯ রোগী শনাক্ত হওয়ার আঠারতম দিনে আমরা লকডাউনে গিয়েছিলাম। তারও আগে নবম দিনে বন্ধ করা হয়েছিল স্কুলকলেজবিশ্ববিদ্যালয়। যার কারণেই কোভিড১৯ দানবটি এদেশে লাফিয়েলাফিয়ে বাড়তে পারেনি। আর যদি জানতে চান লাফিয়ে বাড়েনি ভাল কথা, বেড়ে তো চলেছে ঠিকই। কেন আজ পর্যন্ত আমরা দানবটিকে ধরাশায়ী করতে পারলাম না? কেন ফ্ল্যাট করতে পারলাম না কোভিড১৯ কার্ভটিকে? এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু দিতে হবে আপনাকে এবং আমাকে

খেয়াল করে দেখবেন সরকার কিন্তু লকডাউনটা ঢিলা করেছে খুবই সচেতন ভাবে খোলা হয়নি স্কুলকলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়, যেমনটি করা হয়েছে ইউরোপের কোথাও কোথাও। ইউরোপের কোথাও কোথাও যখন চালু করা হয়েছে নির্মাণকাজ, আমরা হাঁটিনি সেই পথেও। এদেশে এখনও নির্মাণকাজ চালু করার সরকারি অনুমতি জোটেনি। এদেশে অনুমতি দেয়া হয়েছে দোকানপাট খোলার আর খুলে দেয়া হয়েছে উপাসনালয়। তারপরও তা বাধ্যতামূলক নয়। দোকান খোলার জন্য সরকার কাউকে বাধ্য করছেন না কিংবা ঈদের শপিং না করায় ভ্রাম্যমান আদালত কাউকে দণ্ডিত করেছেন এমন কথাও আসেনি কোনো মিডিয়াতে

কাজেই আমাদের দেশের কোভিড১৯এর কার্ভ এখনও কেন দণ্ডায়মান এর উত্তর সরকারের কাছে না খুঁজে বরং নিজের কাছেই খুঁজুন। বড়জোর প্রশ্নটা ছুড়ে দিতে পারেন পরিচিত কোনো গার্মেন্টস ব্যবসায়ী নেতাকে। আর কারো কাছে এর উত্তর খোঁজার দরকার আছে বলে মনে হয় না। দেশে কোভিড রোগীর সংখ্যা রেকর্ড ছাড়ানোয় যারা খুব বেশি টেনশন করছেন তাদের মনটা ভাল করতে একটু শপিং সেন্টার থেকে ঘুরে আসার পরামর্শ দিয়েছেন ফেসবুকে আমার এক বন্ধু। লেখাটা শেষ করছি বটে কিন্তু ফেসবুকের পোস্টটা নিছক রসিকতা না ওটাই আমাদের বাস্তবতা এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here