খর৭১ঃ দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিনজনের অবস্থা আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর। এদিকে মঙ্গলবার দেশের সাতটি জেলায় অন্তত ৬৮ জনকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।
এদের প্রত্যেকেই সম্প্রতি বিদেশফেরত। এছাড়া প্রথম শনাক্ত হওয়া আক্রান্ত দুজনের সংস্পর্শে আসা ৪০ জনসহ সবমিলিয়ে শতাধিক ব্যক্তি বর্তমানে কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। এদের অনেকেই জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত হলেও আতঙ্কের কোনো কারণ নেই বলে জেলাগুলির সিভিল সার্জন ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আটটি জেলার প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে জানা গেছে, মানিকগঞ্জে ৫৯ জন, নোয়াখালীতে ইতালিফেরত এক প্রবাসী, যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় সৌদিফেরত দুই নারী, রাজবাড়ীতে ইতালিফেরত বাবা-ছেলে, চট্টগ্রামে বিদেশফেরত শিক্ষক ও পাবনায় বিদেশফেরত তিনজন কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন।
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, মানিকগঞ্জে বিদেশ ফেরত ৫৯ জন ব্যক্তিকে হোম কোয়ারেন্টাইনে (বাড়িতে বিশেষ ব্যবস্থায়) রাখা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকালে জেলার সিভিল সার্জন একেএম আনোয়ারুল আমিন আখন্দ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৫৯ জন ব্যক্তি মানিকগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় নিজ বাড়িতে এসেছেন। এদের মধ্যে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় ৩২ জন, শিবালয়ে ৬ জন, সাটুরিয়ায় ১৮ জন, দৌলতপুরে ২ জন এবং সিঙ্গাইরে ১ জন ব্যক্তি রয়েছেন। চীন, ইতালি, দক্ষিণ আফ্রিকা, কুয়েত, সৌদিআরব এবং সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশ থেকে তারা এসেছেন।
সিভিল সার্জন বলেন, বিদেশ ফেরত এসব ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন নারী রয়েছে। তাদের সবাইকে নিজ নিজ বাসায় বিশেষ ব্যবস্থায় (হোম কোয়ারেন্টাইনে) রাখা হয়েছে। তাদের পরিবারের সদস্যদেরও বাড়ির ভেতরে রাখা হয়েছে। বিদেশ ফেরত এসব ব্যক্তিদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের কারো স্বাস্থ্যের কোনো সমস্যা নেই।
তিনি আরো বলেন, এসব ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের কাউকে বাড়ি থেকে বাইরে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন।
এ দিকে জেলা প্রশাসন এসএম ফেরদৌস জানান, মানিকগঞ্জ পৌর এলাকার কেওয়ারজানী এলাকায় আঞ্চলিক জনসংখ্যা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউশনে নতুন ভবনে ১০০ শয্যার কোয়ারেন্টাইন ইউনিট খোলা হয়েছে। জেলা হাসপাতালের পুরাতন ভবনের দোতলায় একটি বড় আয়তনের কক্ষে ১২ শয্যার আইসোলেশন ইউনিটও খোলা হয়েছে। বিদেশ ফেরত আসা ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যগত কোনো সমস্যা দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হবে। গঠন করা হয়েছে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মাল্টিসেক্টরাল সমন্বয় কমিটি, র্যাপিড রেসপন্স কমিটি এবং কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনা কমিটি।
রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দিতে সম্প্রতি ইতালিফেরত বাবা ও ছেলেকে নিজ বাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন। গত ২ মার্চ তারা ইতালি থেকে দেশে ফিরেছেন।
তবে প্রশাসন বলছে, বাবা-ছেলে দুজনেই সুস্থ আছেন, তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নন। গত সোমবার মিডিয়ায় তিনজনের করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের খবর ছড়িয়ে পড়লে বালিয়াকান্দি এলাকাবাসী দাবি তোলেন এই বাবা-ছেলেকে কোয়ারেন্টাইনে রাখার জন্য। পরে মঙ্গলবার বিকাল তিনটার দিকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) একেএম হেদায়েতুল ইসলাম।
ইউএনও বলেন, সোমবার রাত থেকে নিজ বাড়িতেই ইতালিফেরত বাবা-ছেলেকে গ্রাম পুলিশের পাহারায় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে এবং স্থানীয়দের সচেতন করা হয়েছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ তাদের মধ্যে করোনার লক্ষণ দেখা যায়নি।
রাজবাড়ীর সিভিল সার্জন ডা. নুরুল ইসলাম বলেন, তাদের মধ্যে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নেই। তারা সম্পূর্ণ সুস্থ। সতর্কতার জন্য তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। জেলায় এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়নি। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এটি ভাইরাসজনিত রোগ। এর চিকিৎসাও খুব জটিল নয়। অধিকাংশ রোগী সুস্থ হয়ে যায়।
নোয়াখালী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নে এক কাতার প্রবাসীকে কোয়ারেন্টাইন রাখা হয়েছে। গত সোমবার বিকালে কাতার থেকে বাংলাদেশে আসেন ওই যুবক। তিনি কাতারে থাকাকালীন দীর্ঘ ১৫দিন ধরে জ¦র ও কাশিতে ভুগছেন। মঙ্গলবার সকালে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তার উপসর্গগুলো দেখে করোনা সন্দেহে তাকে নিজ বাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে থাকার অনুরোধ করেন।
হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মোহাম্মদ ইউছুফ জানান, সকালে রাতুলের ভগ্নিপতি আব্দুর রহিম তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। তার জ¦র, গলা ব্যাথা, কাশি ও মাথা ব্যাথা এসব উপসর্গ দেখে সন্দেহ হওয়ায় কাতার প্রবাসীকে নিজ বাড়িতে কোয়ারেন্টাইন রাখা হয়েছে। তার ভগ্নিপতিকেও কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
যশোর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, মণিরামপুর উপজেলায় করোনাভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে সৌদিফেরত এক নারীকে দুই সপ্তাহের জন্য কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। গত সোমবার রাতে ওই নারী গলায় ব্যাথা ও কাশি নিয়ে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে বিষয়টি কর্তব্যরত চিকিৎসকের নজরে আসে। পরে ওই নারীর কথায় বেরিয়ে আসে তিনি সৌদি থেকে দেশে ফিরেছেন। এরপর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তার কাছে নেয়া হলে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ওই নারীকে তার নিজ বাড়িতে দুই সপ্তাহের জন্য কোয়ারেনটাইনে থাকতে বলেন। তবে, ওই নারীর শ্বাসকষ্ট কিংবা জ্বর না থাকায় আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শুভ্রা রানী দেবনাথ।
তিনি বলেন, ওই নারী গত শনিবার সৌদি থেকে দেশে ফিরেছেন। তাকে মাস্ক ব্যবহার এবং ঘর থেকে বের না হওয়ার জন্য বলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআরে’র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আলমগীর হোসেনের সঙ্গে কথা বললে তিনি এই পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান শুভ্রা রানী দেবনাথ।
চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, জেলায় করোনা আক্রান্ত সন্দেহে এক নারীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে সৌদি ফেরত এই নারীকে জেলার দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানে করোনা আইসোলেশন ইউনিটের একটি কক্ষে রেখে তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ওমরা পালন শেষে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ওই নারী (৬৫) দেশে ফেরেন বলে জানিয়েছে তার পরিবার।
পারিবারিক সূত্র জানায়, গত ৩১ জানুয়ারি তার তিনি ওমরা পালনের জন্য দুবাই হয়ে সৌদি আরবে যান। ওমরা পালন শেষে শরীরে জ্বর ও ব্যথা নিয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দেশে ফেরেন। দেশে ফেরার পর আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। শরীরে প্রচণ্ড জ্বরের পাশাপাশি দেখা দেয় কাঁপুনি ও কাশি। সোমবার তাকে দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের কাছে নেয়া হয়। চিকিৎসকরা জ্বর কাশির ওষুধ দিয়ে ওই দিনই বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। পরে সকালে হাসপাতাল থেকে লোকজন এসে তাকে বাড়ি থেকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রাখেন।
দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. মকবুল হোসেন জানান, স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শ মোতাবেক ওই নারীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে তাকে হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন ইউনিটের একটি কক্ষে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. এএসএম মারুফ হোসেন নিশ্চিত করেছেন সৌদি ফেরত ওই নারীকে করোনা আক্রান্ত সন্দেহে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পাবনা প্রতিনিধি জানান, করোনাভাইরাস আক্রান্ত সন্দেহে বিদেশফেরত তিন ব্যক্তিকে ‘হোম কোয়ারেন্টাইনে’ রাখা হয়েছে। ওই তিনজনের শরীরে এখনো করোনার কোনো লক্ষণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে মঙ্গলবার জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ জানান, গত দুই দিনে জেলার আটঘরিয়া ও ঈশ্বরদীতে তিন ব্যক্তি বিদেশ থেকে ফিরেছেন। তাদের প্রত্যেককে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহ তাদের বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করা হয়েছে। তবে কারও শরীরে এখন পর্যন্ত করোনার কোনো লক্ষণ পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, ইতালি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন শেষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসার পর এক শিক্ষককে ১৫ দিনের জন্য নিজ বাসায় থাকার (হোম কোয়ারেন্টাইন) পরামর্শ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু তৈয়ব।
এই কর্মকর্তা বলেন, ইতালি থেকে ফেরা ওই শিক্ষককে ১৫ দিনের জন্য হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। তাঁর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হবে। তাকে কিছু পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
পাঁচ বছর ধরে ইতালিতে ওই শিক্ষক পিএইচডি করেছেন। ৫ মার্চ ইতালি থেকে আসার পর ওই শিক্ষকের স্বাস্থ্যপরীক্ষা ঠিকমতো হয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তাই তাকে নিজের বাসায় থাকতে বলা হয়েছে।