খবর৭১ঃ ব্যক্তিজীবনে তার পদচারণা ছিল বহুমাতৃক। ছিলেন বরেণ্য ভাস্কর। রাষ্ট্র তাঁকে সম্নানিত করেছিল সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে এবং তা শিল্পকলায়। ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতি আদায়ে সোচ্চার এই মহীয়সী নারী সবার আগে এগিয়ে এসে বলেছিলেন, “আমি বীরাঙ্গনা”। বীরাঙ্গনাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি অর্জন তাঁর অনেক অর্জনের অন্যতম। যুদ্ধাপরাধের বিচার আর মৌলবাদ বিরোধী যুদ্ধে তিনি ছিলেন সম্মুখ কাতারের যোদ্ধা। বহুমাতৃক এই মহীয়সী নারীর সাথে আমার সম্পর্কটাও ছিল বহুমাতৃক।
বাংলাদেশের আর দশ জন নাগরিকের মতই একটি স্বাধীন পতাকা আর একটি মানচিত্র উপহার দেয়ায় তার প্রতি যে কৃতজ্ঞতা সেই সম্পর্কের জায়গাটাতো ছিলোই, ছিলো তার চেয়েও বেশি কিছু। আমার শাশুড়ী শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর তিনি ছিলেন আদরের ছোট বোন, রাজপথের সহযোদ্ধাতো বটেই। কাজেই সেই হিসেবে বৈবাহিক সূত্রে তার সাথে আমার ছিল বিনি সুতায় গাঁথা এক ধরণের আত্মীয়তা। আর নির্মূল কমিটির একজন কর্মী হিসেবে তাঁকে চিনেছি সম্মুখ সারির একজন নেত্রী হিসেবে। তবে তাঁর সাথে আমার যে সর্বশেষ সম্পর্ক তা ছিল পেশাগত একজন চিকিৎসক হিসেবে। আর এই সম্পর্কের জায়গাটি ছিল একবারেই অনন্য কারণে। এখানে ভাগ বসাতে পারেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা নেহাতই হাতে গোনা। সঙ্গত কারণেই এই সম্পর্কের কারণে তার শেষ দিনগুলোতে তাঁকে দেখার আর চেনার যে সুযোগ আমি পেয়েছি তা পেয়েছেন খুব কম লোকই। আর যতই চিনেছি ততই শ্রদ্ধাবনত হয়েছি। তাই তাঁকে নিয়ে আজ যখন লিখতে বসেছি তখন প্রিয়ভাষিণীর সাথে আমার এই সম্পর্কের সূত্র ধরে আমার চেনা তাকে সবার সামনে তুলে ধরাই সম্ভবত সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করছি। যে কোন হিসেবেই তাঁকে নিয়ে লেখার আর বলার জন্য আমার চেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন লোকের সংখ্যা অনেক অনেক বেশী। সেরকম কোন চেষ্টাও আমি তাই করতে চাই না। তাঁর সাথে আমার রোগী-চিকিৎসকের সম্পর্কটা বোধ করি বছর তিনেকের। এই ক’বছরে তিনি ঢাকার একটি বেসরকারী হাসপাতাল আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে বার কয়েক ভর্তি হয়েছেন, একাধিকবার আমার চেম্বারে এসেছেন আর যখনই কোন সভায় বা হাসপাতালে দেখা হয়েছে হাস্যোজ্জল মুখে ‘ডাক্তার সাহেব’ বলে জড়িয়ে ধরেছেন। পায়ের ব্যথায় তিনি বরাবরই কষ্ট পেতেন। তবুও বারবার ছুটে বেড়াতেন এই সভা থেকে সেই সভায় আর নির্মূল কমিটির এই কর্মসূচী থেকে সেই কর্মসূচীতে। পায়ের ব্যথা নিয়ে তাঁর যে দুশ্চিন্তা তার চেয়ে বেশী দুশ্চিন্তা ছিল এই শঙ্কায় যে যদি তিনি পায়ের ব্যথায় পর্যুদস্ত হয়ে নির্মূল কমিটির কর্মসূচীতে আর যোগ দিতে না পারেন।
এমনি পা ব্যথা আর নানা রোগকে পাত্তা না দিয়েই গত আগস্টে ধানমন্ডির একটি আর্ট গ্যালারীতে আয়োজন করেছিলেন তার সর্বশেষ প্রদর্শনীটি। আমাকে আর আমার সহধর্মিনী ডাঃ নুজহাত চৌধুরীকে বারবার তাগাদা দিয়েছিলেন যাওয়ার জন্য। আমরা গিয়েছিলাম প্রদর্শনীটির শেষ দিন ২২ আগস্ট, কাকতালীয়ভাবে আমার জন্মদিনে। তিনি ছিলেন মূলত ভাস্কর। রং-তুলির কাজ তাঁর ছিল না বললেই চলে, সম্ভবত হাতে গোনা দু’তিনটি। আমরা তাঁর পছন্দের একটি ভাস্কর্য আর একটি পেইন্টিং কিনেছিলাম। আমার জন্মদিন জেনে নিজ হাতে ভাস্ক‹র্যে অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন। এই অমূল্য শিল্পকর্ম দুটি আজো আমাদের ড্রইংরুমে আমাদেরকে একজন প্রিয়ভাষিণীর কথা খুব বেশী করে মনে করিয়ে দেয়। আর ঐ যে তাগাদা দিয়ে ডেকে নিয়েছিলেন তার তাগিদটাও ছিল খুব সোজাসাপ্টা। সেদিনের প্রদর্শনীতে বিক্রি হওয়া প্রতিটি শিল্পকর্মের বিক্রয়মূল্য তিনি অবলীলায় দিয়ে দিয়েছিলেন তার প্রিয় সংগঠন নির্মূল কমিটির তহবিলে। এই ছিলেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী! জীবনের কাছে তার চাহিদা ছিল সামান্যই, দেয়ার তাগিদ ছিল অনেক বেশী। শেষবার যখন হাসপাতালে ভর্তি, গভীর রাতে দেখতে গিয়েছি, বললেন ‘স্বপ্নীল, খুব ফল খেতে ইচ্ছে করছে’। তার আব্দার ছিল ছোট্ট একটা দেশী কলার। এর বেশী কিছু না। তারপরই আবার সেই ব্যাকুলতা সুস্থ হয়ে আবার নির্মূল কমিটির কর্মসূচীতে যেতে পারবেন কিনা? তাঁকে আমার সদ্য প্রকাশিত বই ‘সেকাল একালের কড়চা’-র একটা কপি উপহার দিয়েছিলাম। কি প্রচন্ড আগ্রহে নিলেন, আর তারপরই জানতে চাইলেন অটোগ্রাফ দেইনি কেন। এত বিশাল একজন মানুষ আমার মতন একজন লেখকের অটোগ্রাফ প্রার্থী কতটা বিশাল হৃদয়ের অধিকারী হলে এতটা উদার হওয়া যায় ভাবতে ভাবতে তার কেবিন থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম সে রাতে।
ভারতে বেসরকারী স্বাস্থ্য খাতের এখন বাড়বাড়ন্ত অবস্থা। বিশাল সব অত্যাধুনিক বেসরকারী হাসপাতাল। তেমনি একটি কোচিনের অ্যাস্টার মেডসিটি। আমি হাসপাতালটির ভিজিটিং কনসালটেন্ট। সেই সুবাদে ওখানকার অনেকের সাথেই আমার সখ্য। এদের অন্যতম হাসপাতালটির সিইও ডাঃ হারিশ পিল্লাই। গত নভেম্বরে প্রিয়ভাষিণী আন্টি যখন হাসপাতালে ভর্তি, ডাঃ পিল্লাই তখন পেশাগত কাজে ঢাকায়। আমার মুখে শুনলেন একজন প্রিয়ভাষিণীর কথা। ওনার রিপোর্টগুলো চেয়ে নিয়ে পাঠিয়ে দিলেন কোচিনে। বিকেলে জানালেন প্রিয়ভাষিণীর মতন একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদানে তার হাসপাতালের আগ্রহের কথা। রাতে আন্টিকে জানালাম। মনে হল খুব বড় কোন অপরাধ করে ফেলেছি। এক কথায় নাকচ। বললেন ‘তোমরাই সেরা, তোমরাই আমার চিকিৎসা করবে’। আরেকবার শ্রদ্ধাবনত হলাম।
সেবারই প্রিয়ভাষিণী আন্টির চিকিৎসার জন্য গঠিত হয়েছিল একটি মেডিকেল বোর্ড। বোর্ডের সদস্যরা প্রত্যেকে স্বনামখ্যাত এবং পাশাপাশি স্বাধীনতার স্বপক্ষীয়। বোর্ডের সিদ্ধান্ত পায়ের হাড়ের ফ্র্যাক্চারের অপারেশনের জন্য তিনি বিদেশ গেলে মন্দ হয় না। এদেশে চিকিৎসা আছে ঠিকই তবুও তার মতন একজন গুরুত্বপুর্ণ নাগরিক বলে কথা বিদেশে যাওয়া যেতেই পারে। বোর্ডের সিনিয়র সদস্য একজন মুক্তিযোদ্ধা বিশেষজ্ঞ তাকে বোর্ডের সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। মন দিয়ে খাটে শুয়ে সব শুনলেন প্রিয়ভাষিণী আন্টি। তারপর গেয়ে উঠলেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি’। দু’গাল বেয়ে তাঁর গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা। বললেন, ‘ডাক্তার সাহেবরা, আমাকে বাংলাদেশে মরতে দিন’।
জীবনে তিনি সংগ্রাম করেছেন অনেক। একাত্তরের দুঃসহ দিনগুলো তার জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছিল অনেকগুলো বছর। বয়স তেমন না হলেও হয়েছিল। তবুও মানসিক প্রস্তুতি ছিল না তাঁকে বিদায় জানানোর। ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি তাঁর স্মৃতিচারণের খাতা-কলম নিয়ে বসতে হবে। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীরা কেন যেন খুব তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছেন। আমার দেখা প্রিয়ভাষিণী আন্টি সম্ভবত একটি খেদ নিয়ে চলে গেছেন। আর তা হলো তিনি দেখে যেতে পারেননি ‘বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জামাত’ আর ‘মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইন’ বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত। আজ যখন আমরা একজন প্রিয়ভাষিণীর শোকে শোকার্ত তখন আমাদের সবার প্রত্যাশা আর পাশাপাশি করণীয় এতটুকুই হওয়া উচিত যেন আর কোন প্রিয়ভাষিণী এই খেদ নিয়ে বিদায় না নেন। আরো কোন প্রিয়ভাষিণীর স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে আমাদের যেন এই একই কথা লিখতে না হয়!