খবর৭১ঃ প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস চীন থেকে দ্রুত অর্ধশতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্ব জুড়ে সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্ক। তরতর করে বেড়েছে ফেস মাস্কের চাহিদা। চীনে মাস্কের ঘাটতি দেখা দেয় কয়েক দিনের মধ্যেই।
এবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও মাস্ক সংকট দেখা দিয়েছে। এটা চলতে থাকলে চিকিত্সক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের চরম বিপাকে পড়তে হবে। কারণ চিকিত্সক-নার্সদের মাস্ক ব্যবহার করা অত্যাবশ্যকীয়।
গত মাসে নিউ ইয়র্ক সিটির একটি দোকান ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে দরজার বাইরে কাগজের সাইন বোর্ড টানিয়ে দিয়েছিল। তাতে লেখা ছিল :লুনার নিউ ইয়ার (চন্দ্র নববর্ষ)-এর দ্বিতীয় দিন উদ্যাপনে আজ যে কোনো ক্রেতা বিনামূল্যে একটি করে মাস্ক পাবেন। এর এক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি পুরো পালটে যায়। বিশেষ করে করোনা ভাইরাসে নিউ ইয়র্কে প্রথম আক্রান্ত একজনের মৃত্যুর পর মাস্কের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন মানুষ। এতে সেখানে চরমভাবে মাস্ক সংকট দেখা দিয়েছে। এদিকে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মাস্কের দামও বৃদ্ধি করা হয়েছে অধিকাংশ দেশে। চাহিদা বাড়ায় অনলাইন কেনাবেচার সাইটে একটি মাস্ক বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১৪ হাজার টাকায়।
বিশ্ব জুড়ে ফেস মাস্ক ঘাটতির কারণে ইলেকট্রনিক পণ্য উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফক্সকন চীনের শেনজেন-এ মাস্ক তৈরির জন্য একটি আলাদা কারখানা স্থাপন করেছে। এ থেকে বাজারে মাস্কের চাহিদা আন্দাজ করা যায়। ফক্সকন সাধারণত অ্যাপলের আইফোন তৈরি করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, প্রতিদিন গড়ে ২০ লাখ মাস্ক উত্পাদন করতে পারবে বলে প্রত্যাশা করছে তারা। এমনকি ঘাটতি দেখা দিয়েছে রেসপাইরেটরেরও। মাস্কের চেয়ে ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে রেসপাইরেটরগুলো বেশি কার্যকরী। হংকংয়ে ফার্মেসিগুলোয় দেখা গেছে ক্রেতাদের লম্বা লাইন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে মাস্ক কিনছেন মানুষ। মাস্কের চাহিদা এত বেড়েছে যে, কিছু ফার্মেসি ক্রেতাদের কাছে বিক্রিযোগ্য মাস্কের সংখ্যা সীমিত করে দিয়েছে। একজনের কাছে নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি মাস্ক বিক্রি করা হচ্ছে না। ফিলিপাইনে সরকারি উদ্যোগে হাইস্কুল ও কলেজগুলোয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সার্জিক্যাল মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও সেখানকার বাজারে মাস্কের ঘাটতি দেখা দিয়েছে, ম্যানিলা, পাগাদিয়ান সিটি ও বুকিদননের মতো শহরগুলোয় পাওয়া যাচ্ছে না পর্যাপ্ত মাস্ক। থাইল্যান্ড মাস্ক রপ্তানি সীমিত করে দিয়েছে। ফ্রান্সে রেসপাইরেটরি মাস্ক উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান কলমি হোপেন স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় উত্পাদন চার থেকে পাঁচ গুণ বাড়িয়েছে। ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত কর্মী খুঁজছে প্রতিষ্ঠানটি। যুক্তরাষ্ট্রেও মাস্কের সংকট দেখা গেছে। ৯৬ শতাংশ ফার্মেসিতে সার্জিক্যাল মাস্কের সংকট দেখা দিয়েছে।
করোনা ভাইরাসে বিশ্ব জুড়ে মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছেছে প্রায় ৯০ হাজারে। এই ভাইরাসে ৯০ শতাংশের বেশি মৃত্যু ঘটেছে চীনের হুবেই প্রদেশে। চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে আরো ১১টি জায়গায় ১৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনা ভাইরাস। এর মধ্যে ইরানে ৫৪ জন এবং ইতালিতে ৩৪ জনের প্রাণ গেছে।
বিবিসি বলছে, চীনের চেয়ে এখন চীনের বাইরে এ ভাইরাস ছড়াচ্ছে দ্রুতগতিতে। তবে অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে কেবল মৃদু উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রবিবার জানিয়েছে, করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর হার ২ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে। চীনে জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন জানিয়েছে, রবিবার দেশটির মূল ভূখণ্ডে ২০২ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ৪২ জনের। সব মিলিয়ে চীনের মূল ভূখণ্ডে আক্রান্তের মোট সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৮০ হাজার ২৬ জনে; আর মৃত্যু হয়েছে মোট ২ হাজার ৯১২ জনে। চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে ইরানে ৫৪ জন, ইতালিতে ৩৪ জন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ২৬ জন, জাপানে ১২ জন, হংকং, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রে ২ জন করে এবং ফিলিপিন্স, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া ও থাইল্যান্ডে একজন মনে মারা গেছেন করোনা ভাইরাসে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির একজন শীর্ষ উপদেষ্টা করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। সরকারি বেতারের খবরে বলা হয়েছে, মোহাম্মদ মীর মোহাম্মদী (৭০) তেহরানের একটি হাসপাতালে করোনা ভাইরাসের চিকিত্সা নিচ্ছিলেন। সোমবার তিনি মারা যান। করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবে উত্সস্থল চীনের বাইরে অন্য দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোকের মৃত্যু হয়েছে ইরানে। অন্য দেশটি ইতালি। ইরান থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ১০টিরও বেশি দেশে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে। অপরদিকে উত্তর ইতালি থেকে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশসহ দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশেও ভাইরাসটি ছড়িয়েছে।
করোনা ভাইরাসের সঙ্গে তাপমাত্রার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই জীবনাচরণ পরিবর্তনের পরামর্শ জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর)। গতকাল সোমবার করোনা প্রসঙ্গ নিয়ে প্রতিদিনকার ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. সেব্রিনা মীরজাদী ফ্লোরা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসের আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ায় বিশ্ব পরিস্থিতির অবনতি। তাপমাত্রার সঙ্গে করোনা ভাইরাসের কোনো সম্পর্ক নেই। উচ্চ তাপমাত্রা আছে এমন দেশেও করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হচ্ছে। করোনা ভাইরাস ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় টিকতে পারে না। কোনো দেশেই এত তাপমাত্রা নেই। এ সময় তিনি কোলাকুলি, হ্যান্ডশেক পরিহার করতে অনুরোধ করেন।
এদিকে, বিশ্ব জুড়ে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ফ্রান্সে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া লোকজনকে বিদেশ সফরে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কোভিড-১৯ ভাইরাস আতঙ্কে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ঐতিহাসিক লুভর মিউজিয়াম। অন্যদিকে, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও বিতর্কিত বিজেপি নেতা যোগি আদিত্যনাথ বলেন, নিয়মিত যোগব্যায়াম চর্চার মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের মতো কঠিন ও প্রাণঘাতী রোগ সারানো সম্ভব।