খবর৭১ঃ শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতায় নেয়া সরকারের পদক্ষেপ তেমন কাজে আসেনি। লেনদেনে গতি ফেরেনি। মূল্যসূচকে এখনও অস্থিরতা বিরাজ করছে। তবে এতে সাময়িকভাবে পতন কমছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি।
বাজার স্থিতিশীল করতে সরকার সম্প্রতি বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কয়েক বছর আগেও সংকট কাটাতে ব্যাপক প্রণোদনা দিয়েছিল সরকার। বাজারসংশ্লিষ্টদের প্রায় সব দাবিই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পূরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে কর অবকাশ সুবিধা, প্রাথমিক শেয়ারে (আইপিও) বিশেষ কোটা, বিভিন্ন আইন-কানুন শিথিল করা এবং ঋণ সুবিধা অন্যতম।
এতকিছুর পরও দীর্ঘমেয়াদে বাজারে এর প্রভাব নেই, উল্টো ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নয়, নির্দিষ্ট একটি চক্র এই প্রণোদনার সুবিধা পাচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পক্ষ থেকেও শক্ত পদক্ষেপ আসছে না।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন বাজারে মূল সমস্যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট। এই সংকট কাটাতে প্রণোদনা নয়, সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। পতনের কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন জরুরি।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকট না কাটলে বাজার ইতিবাচক হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। তিনি বলেন, প্রণোদনা দিলে বাজারে সাময়িকভাবে উপকৃত হয়। এটি স্থায়ী কোনো সমাধান নয়।
তার মতে, বাজার উন্নয়নে মূলত তিনটি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এর মধ্যে প্রথমত, সরকারি ও বেসরকারি ভালো কোম্পানি নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে ৬টি কোম্পানি আনার কথা বলা হচ্ছে। এগুলোর আয়ের সক্ষমতার ব্যাপারে আমরা জানি না। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকিং খাতের সমস্যা রয়েছে। এই সমস্যা না কাটলে বাজার উন্নয়নের কোনো সম্ভাবনা দেখি না।
তৃতীয়ত, রেগুলেটরি সমস্যা কাটাতে হবে। উদাহরণ দিয়ে মির্জ্জা আজিজ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামীণফোনের ওপর কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। শুনেছি নতুন করে তারা আর সিম বিক্রি করতে পারবে না। আর গ্রামীণফোনের দাম কমলে বিনিয়োগকারীরা ভয়ে অন্য কোম্পানির শেয়ারও বিক্রি করে দেয়। এছাড়া অন্যান্য কোম্পানির আয় ভালো না। তার মতে, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর যাতে আয় বাড়ে, সেই উদ্যোগ নিতে হবে।
জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুতেই শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়। এ সময় বাজার উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট ৬টি পদক্ষেপের কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসবের মধ্যে আছে- পুঁজিবাজারে ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বাড়ানো, মার্চেন্ট ব্যাংকার ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা, সরকারি প্রতিষ্ঠান আইসিবির বিনিয়োগ সক্ষমতা বাড়ানো।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আরও আছে, দেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা ও দেশীয় বাজারে আস্থা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ এবং বাজারে মানসম্পন্ন আইপিও বৃদ্ধির লক্ষ্যে বহুজাতিক ও সরকারি মালিকানাধীন লাভজনক কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করা। অন্যদিকে পর্যায়ক্রমে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা চিহ্নিত করে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া বিদ্যমান আইন অনুসারে ব্যাংকগুলো তার রেগুলেটরি ক্যাপিটালের ২৫ শতাংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংকের বিনিয়োগ ১৫ শতাংশেরও কম। এ অবস্থায় বাজারের উন্নয়নে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকারি চার ব্যাংক। এগুলো হল- সোনালী, অগ্রণী, জনতা এবং রূপালী ব্যাংক। এরপর দুই দিন ইতিবাচক ছিল বাজার। পরবর্তীকালে আবারও পতন শুরু হয়।
বাজার পরিস্থিতি : গত বছরের মার্চে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। এরপর ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত তা কমে ৩ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে। এ অবস্থায় বাজার উন্নয়নে পদক্ষেপ ঘোষণা করে সরকার। এরপর কয়েকদিন বাড়ে সূচক। বর্তমানে ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে বাজার মূলধন। ডিএসইর মূল্যসূচক সাড়ে ৪ হাজার পয়েন্টের নিচে রয়েছে। লেনদেন এখনও ৫শ’ কোটি টাকার নিচে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের বাজেটে শেয়ারবাজারে তিনটি সুবিধা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিনিয়োগকারীদের করমুক্ত লভ্যাংশ দ্বিগুণ করা হয়েছে। কোনো বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি থেকে ৫০ হাজার টাকা লভ্যাংশ পেলে, তাকে কোনো কর দিতে হবে না।
গত অর্থবছরে এই সীমা ছিল ২৫ হাজার টাকা। এছাড়া তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট কর কমানো হয়েছে। আগে এই হার ছিল ৪০ শতাংশ। এবারের বাজেটে তা ২ দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৩৭ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট কর ১৫ থেকে কমে সাড়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে।
বাজেটের আগেও বেশকিছু সুবিধা দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে চীনের বিনিয়োগ থেকে স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যরা যে অর্থ পেয়েছিল, শেয়ার কেনার শর্তে ওই টাকার ওপর ১০ শতাংশ কর অবকাশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ সদস্য আগে থেকেই শেয়ার বিক্রি করে তাদের ডিলার অ্যাকাউন্ট খালি করে রাখে।
এরপর চীনের টাকা পেয়ে তারা নতুন করে কিছু শেয়ার কিনেছে। অর্থাৎ টাকা কর অবকাশ সুবিধা নিয়েও তাদের বিনিয়োগ করতে হয়নি। এভাবে বিনিয়োগকারীদের জিম্মি করে বিভিন্ন উপায়ে সুবিধা আদায় করে নিয়েছে একটি চক্র।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, শেয়ারবাজারে বর্তমানে যে সংকট চলছে, সেটি প্রণোদনার নয়। ফলে প্রণোদনা দিয়ে বাজারের উন্নয়ন হবে না। তিনি বলেন, এখানে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট চলছে। এই সংকট না কাটলে স্থায়ী সমাধান হবে না। এক্ষেত্রে আস্থা বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে। টানা পতনের কারণ অনুসন্ধানে প্রয়োজনে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত।
আগের যত প্রণোদনা : বিপর্যয়ের পর ২০১১ সালেও বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশের ওপর কর দিতে হতো। স্টক এক্সচেঞ্জের দাবির কারণে ধাপে ধাপে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লভ্যাংশ করমুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ডিমিউচুয়ালাইজেশনের পর স্টক এক্সচেঞ্জকে ৫ বছর কর অবকাশ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম বছরে শতভাগ করমুক্ত। এছাড়া কোনো কোম্পানি বা অংশীদারি ফার্ম পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ থেকে যে টাকা মুনাফা করে, তার ওপর ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর দিতে হতো। বর্তমানে তা করমুক্ত করা হয়েছে।
অর্থাৎ কোনো কোম্পানি শেয়ারবাজার থেকে মুনাফা করলে উৎসে কর দিতে হয় না। মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসসহ সংশ্লিষ্ট ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হিসাবের ৫০ শতাংশ সুদ মওকুফ করেছে। বাকি ৫০ শতাংশ সুদ ব্লক অ্যাকাউন্টে রেখে তিন বছরে কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেয়া হয়েছিল।
আইপিওতে বিশেষ কোটা দেয়া হয়েছে। ২০১২ থেকে কোম্পানির আইপিওতে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য ২০ শতাংশ কোটা দেয়া হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের আওতায় ৯শ’ কোটি টাকা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ২৫ হাজার বিনিয়োগকারী এই সুবিধা পেয়েছে।
এছাড়া ব্রোকারেজ হাউসের পুনর্মূল্যায়নজনিত ক্ষতির বিপরীতে বিশেষ প্রভিশন সুবিধা দেয়া হয়েছে। এর ফলে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত নেতিবাচক হলেও একসঙ্গে প্রভিশনিং করতে হবে না। এছাড়াও ব্যাংক কোম্পানি আইন শিথিল করে ব্যাংকের বিনিয়োগে ছাড়, বিভিন্ন সময়ে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ এবং কর্পোরেট কর কমানো হয়েছে। কিন্তু বাজারে এর প্রভাব খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
জানা গেছে, একের পর এক অজুহাতে সরকারকে জিম্মি করে সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে বাজারসংশ্লিষ্টরা। একটি প্রণোদনার পর কয়েকদিন সূচক বাড়ে। এরপর টানা পতন শুরু হয়। শুরু হয় নতুন বায়না। এভাবেই গত ৯ বছর চলেছে দেশের শেয়ারবাজার।