ইলিশে সয়লাব বরিশালের বাজার

0
514
ইলিশে সয়লাব বরিশালের বাজার
ছবিঃ সংগৃহীত

খবর৭১ঃ বরিশালে ইলিশের সবচেয়ে বড় বাজার (মোকাম) নগরের পোর্ট রোড। সেই বাজারের চিরচেনা রূপ বদলে গেছে। প্রতিবছর শীতের এ সময়ে এই মোকামে সামুদ্রিক মাছের দাপট থাকত, সেখানে পুরো বাজার দখল করে আছে তাজা ইলিশ। শ্রমিকদের ব্যস্ততা, ক্রেতাদের ভিড়, মহাজনদের হাসিমুখ। ঘাটে নোঙর করা ট্রলারগুলোর খোল ভরে আছে রুপালি ইলিশে।

শীতে বরিশালের বাজার ইলিশে ঠাসা। গড়নে উজ্জ্বল এই রুপালি ইলিশ ওজন-আকৃতিতেও বড়। দামও ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে। এক সপ্তাহ ধরে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে ইলিশের এমন প্রাচুর্য অবাক করেছে ব্যবসায়ী, জেলে, ক্রেতাসহ সবাইকে। কারণ, বিগত দিনে এই মৌসুমে এমন ঘটনা আর ঘটেনি।

দেশের ইলিশ বিশেষজ্ঞরা শীত মৌসুমে ইলিশের এমন প্রাচুর্যকে অস্বাভাবিক মনে না করে বরং ইতিবাচক ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম নিয়ামুল নাসের বলেন, এ সময়ে ইলিশের প্রজনন পর্বের দ্বিতীয় অধ্যায়। শীতের শেষ দিকটায় এমনটা হয়। সংরক্ষণ ভালো হওয়ায় এবার ইলিশের পরিমাণ বেড়েছে এবং আকার বড় হয়েছে।

বরিশালের পোর্ট রোডের ব্যবসায়ী জহির উদ্দীন বললেন, ‘কোনো দিন শীতে এত বড় আর এত ইলিশের আমদানি দেখিনি। আগের বছরগুলোতে এই সময়ে ছিটেফোঁটা ইলিশ আসত। তা-ও আকারে ছোট, সেসব ইলিশ তেমন পরিপুষ্ট ছিল না; কিন্তু এবার আমদানি যেমন ব্যাপক, তেমনি ইলিশের আকার বড় এবং পরিপুষ্ট। মনে হয় আমাদের সুদিন ফিরবে ইলিশে।’

ব্যবসায়ীরা বললেন, গত শনিবার এই মোকামে ৫৫০ মণ ইলিশ এসেছে। রোববারও একই পরিমাণ ইলিশ এসেছে। আজ সোমবার কিছুটা কমে গেলেও ৪৫০ মণের মতো এসেছে। এই সময়ে এটা অবিশ্বাস্য।

পোর্ট রোডের মৎস্য আড়দার সমিতির সভাপতি আশরাফ আলী বলেন, ‘মৌসুমে এবার ইলিশ তেমন মেলেনি। এ জন্য জেলে-ব্যবসায়ীরা লাভের মুখ দেখেননি। কিন্তু শীত মৌসুমে অসময়ে ইলিশের আমদানি আমাদের সব কষ্ট ধুয়ে দিয়েছে। দামও কম। ৭০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ২৫ হাজার টাকা। আর এক কেজির ওপরে ওজনের ইলিশ মণপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৩০ হাজার টাকায়। আর ৪৫০ থেকে ৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মণপ্রতি ১২ হাজার থেকে ২০ হাজারের মধ্যে বিক্রি হচ্ছে পাইকারি বাজারে।’

ইলিশে সয়লাব বরিশালের বাজার
ছবিঃ সংগৃহীত

ইলিশের আকারআকৃতি ওজন বাড়ছেঃ

ইলিশের আকার-আকৃতি, ওজন, প্রজনন ও দাম নিয়ে নিয়মিত জরিপ করে মৎস্য অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের ইকো ফিশ প্রকল্প। তাদের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে দেশের ইলিশের গড় আকৃতি ও ওজন বেড়েছে। ২০১৪ সালে ধরা পড়া ইলিশের গড় ওজন ছিল ৫১০ গ্রাম। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৮৮০ গ্রাম। একই সময়ে ধরা পড়া মাঝারি আকৃতির (আধা কেজি থেকে ১ কেজি) ইলিশ ৪০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৭ শতাংশ হয়েছে। আর জাটকা ধরার পরিমাণ ৬০ শতাংশ থেকে কমে ১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এতে ইলিশের গড় দামও গত এক বছরে ২০ শতাংশ কমেছে। অসময়ে আকারে বড় ইলিশ ধরা পড়ার বিষয়টি বিশেষজ্ঞদের সেই ধারণার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

উৎপাদন বাড়ছে, বড় অবদান বরিশালের

ইলিশ আহরণে বরিশাল বিভাগের ঐশ্বর্য ক্রমেই বাড়ছে। গত ১০ বছরে এই বিভাগে ইলিশ আহরণের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি কয়েক বছর ধরেই দেশের মোট ইলিশের ৬৬ ভাগের বেশি আহরিত হচ্ছে এই বিভাগ থেকে। চলতি অর্থবছরেও তা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞরা। পরিসংখ্যান বলছে, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণের পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে ৪ দশমিক ১৯ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সে অনুযায়ী বরিশালেও তা প্রায় ৮ হাজার মেট্রিক টন বৃদ্ধি পায়। মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ইলিশ আহরিত হয় ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৮৮ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগ থেকেই আহরিত হয়েছিল ৩ লাখ ৩২ হাজার ২৫ মেট্রিক টন। এর আগের অর্থবছরে দেশে আহরিত মোট ইলিশের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বরিশাল থেকে আহরিত হয়েছিল ৩ লাখ ২৪ হাজার ২৯৭ মেট্রিক টন, যা দেশে মোট উৎপাদনের প্রায় ৬৬ শতাংশ।

বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, বরিশাল বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইলিশের জোগান দেয় ভোলা ও বরগুনা। ভোলায় গত অর্থবছরে ইলিশ আহরিত হয় ১ লাখ ৬১ হাজার ৮৩২ মেট্রিক টন ও বরগুনায় আহরিত হয় ৭০ হাজার ২৩৭ মেট্রিক টন।

ইলিশ রক্ষায় প্রকল্প

উপকূলের নদ-নদীতে ইলিশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দেশের আট জেলায় ‘ইকো ফিশ’ নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মৎস্য অধিদপ্তর। এর আওতায় দেশে প্রথমবারের মতো ইলিশের বংশবিস্তার, প্রজননকাল নির্ধারণসহ নানা দিক নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। ২০১৫ সালের মার্চে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের মেয়াদ ৫ বছর। প্রায় ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলায়। এতে মৎস্য অধিদপ্তরকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ফিশ।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০০১ সাল থেকে দেশে ইলিশ আহরণের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমতে শুরু করে। এরপর নানামুখী উদ্যোগে ইলিশ আহরণ কিছুটা বাড়ে। তবে ২০১৪ সালের পর এর পরিমাণ অনেকটা বাড়ে। ২০১৬ সালে যেখানে দেশে ইলিশ আহরণের হার ছিল ৩ লাখ ৮৭ হাজার মেট্রিক টন, সেখানে তার পরের বছর থেকে তিন বছরে ধরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৮৮ মেট্রিক টনে। এটা সম্ভব হয়েছে ইলিশ নিয়ে পরিকল্পিত ও বিজ্ঞানভিত্তিক কার্যক্রম হাতে নেওয়ায়।

ইকো ফিশ প্রকল্পের দলনেতা ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন আবদুল ওহাব গতকাল সোমবার বলেন, ‘এই প্রকল্পের আওতায় উপকূলের ইলিশ মাছ অতিমাত্রায় আহরণ থেকে রক্ষা পেয়েছে এবং তা বড় হওয়ার সুযোগ পাওয়ায় দেশে ইলিশের উৎপাদন অবিশ্বাস্য হারে বেড়েছে। এতে ইলিশ মাছের পাশাপাশি অন্য মাছ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পেয়ে সেসবের উৎপাদনও আগের চেয়ে অনেকাংশে বেড়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here