ক্যাসিনো ইস্যুঃ বেরিয়ে আসছে হাই প্রোফাইলদের বিপুল সম্পদ

0
437
ক্যাসিনোবিরোধী মানি লন্ডারিং মামলা: হাই প্রোফাইলদের বিপুল সম্পদ বেরিয়ে আসছে

খবর৭১ঃ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার ৫২টি ব্যাংক হিসার খুঁজে পেয়েছে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। এসব অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে ৪১০ কোটি ৩০ লাখ ৭১ হাজার ৫৫৩ টাকা।

বর্তমানে তার অ্যাকাউন্টে স্থিতি রয়েছে ২৯ কোটি ৬৫ লাখ ৮৪ হাজার ১৪৫ টাকা। বাকি টাকা তিনি বিভিন্ন সময়ে উত্তোলন করেছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এ পর্যন্ত ২৭৮ কোটি ৯ লাখ ৩৯ হাজার ৮৯৪ টাকা উত্তোলনের সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে।

যুবলীগের অপর বহিষ্কৃত নেতা জিকে শামীমের ১৯৪টি ব্যাংক হিসাবের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব অ্যাকাউন্টে ৩২৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা জমা আছে। তার নামে ঋণ আছে ১৪৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

কেবল খালেদ বা শামীমই নয়, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে হাইপ্রোফাইল যাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসছে। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে দেরি হচ্ছে। সিআইডির নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বুধবার এসব তথ্য জানিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির সংশ্লিষ্ট ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ক্যাসিনো ইস্যুতে ছয় হাইপ্রোফাইলসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে আটটি মানি লন্ডারিংয়ের মামলা করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। মামলাগুলো তদন্তের জন্য সিআইডিতে ন্যস্ত হলে প্রতিটি মামলার জন্য পৃথক তদন্ত ও তদারকি কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। পাশাপাশি তদন্তকাজ মনিটরিংয়ের জন্য বিশেষ সেল গঠন করা হয়। ডিসেম্বরের মধ্যেই মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট দেয়ার জন্য তদন্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তদন্তে আসামিদের একের পর এক সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসে। ওইসব সম্পদের তথ্য যাচাই করতে সময় লাগছে। এ কারণে চার্জশিট দিতে সময় লাগছে।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে চার্জশিট প্রায় প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। ওই সময় (২৪ ডিসেম্বর) খালেদের ক্যাশিয়ার মো. উল্লাহ ওরফে মো. আলী সিআইডির জালে ধরা পড়ে। পরদিন ২৫ ডিসেম্বর আদালতে তিনি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। খালেদের অপরাধজগৎ এবং অবৈধ সম্পদের বিষয়ে তিনি বিস্তারিত তথ্য দেন। এ সময় তথ্য যাচাই না করে চার্জশিট দিলে চার্জশিট পূর্ণাঙ্গ হবে না। তাই বাধ্য হয়ে তদন্ত কর্মকর্তাকে সময় দিতে হচ্ছে।

১৮ সেপ্টেম্বর খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় নগদ ১০ লাখ ৩৪ হাজার ৫৫০ টাকা এবং ৭ লাখ ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা সমমানের বিদেশি মুদ্রা জব্দ করা হয়। তদন্তকালে তার মোটা অঙ্কের অর্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। তার জমি ও বাড়ি সংক্রান্ত বিষয়ে এখনও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ চলছে বলে সিআইডির বিশ্বস্ত সূত্র জানায়।

২০ সেপ্টেম্বর আট দেহরক্ষীসহ জিকে শামীমকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে ১ কোটি ৮১ লাখ ২৮ হাজার নগদ টাকা, ৯ হাজার ইউএস ডলার, ৭৫২ ডলার (সিঙ্গাপুর), ১৬৫ কোটি ২৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকার এফডিআর এবং বিভিন্ন ব্যাংকের ৮৭টি চেক বই জব্দ করা হয়। তদন্তকালে পাওয়া তার ১৯৪টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়। এখন তার স্থাবর সম্পদের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে বলে সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান।

২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গেণ্ডারিয়া, ওয়ারী ও সূত্রাপুরে অভিযান চালিয়ে গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু এবং যুগ্ম সম্পাদক রুপন ভূঁইয়ার বাসা থেকে নগদ পাঁচ কোটি পাঁচ লাখ ৯৪২ হাজার ১০০ টাকা জব্দ করা হয়।

এছাড়া চার কোটি টাকা মূল্যমানের স্বর্ণালংকার জব্দ করা হয়। পরে মানি লন্ডারিং মামলার তদন্তে এ পর্যন্ত এনু-রুপনের ২০টির বেশি বাড়ি পাওয়া গেছে। এনুর ৯১টি ব্যাংক হিসাবের বিবরণী পাওয়া গেছে।

এসব হিসাবে ১৯ কোটি ১৯ লাখ ৩৬ হাজার ৩৯৫ টাকা রয়েছে। আদালতের অনুমতি নিয়ে হিসাবগুলো ফ্রিজ করা হয়েছে। এছাড়া এনু-রুপনের তিনটি প্রাইভেট কার ও তিনটি মোটরসাইকেলের তথ্য উদ্ঘাটন করা হয়েছে।

৩০ সেপ্টেম্বর বিদেশে পালানোর সময় থাই এয়ারওয়েজ থেকে অনলাইন ক্যাসিনোর মূল হোতা সেলিম প্রধানকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে নিয়ে বাসায় অভিযান চালিয়ে নগদ ২৮ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ টাকা, ২২টি দেশের বিপুল পরিমাণ মুদ্রা, পাঁচটি কম্পিউটার, একটি সার্ভার, ৩২টি ব্যাংকের চেক বই, একটি ল্যাপটপ ও মোবাইল সেট জব্দ করা হয়। দীর্ঘ অভিযান শেষে সেলিম প্রধানসহ চারজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়।

পরে তাদের নামে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হয়। তদন্তে নেমে সিআইডি এ পর্যন্ত সিআইডি সেলিম প্রধানের নামে থাইল্যান্ডে একটি বাগানবাড়ি, তিনটি বেনামি কোম্পানি, ৮৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, প্রধান’স স্পা হাউস, প্রধান’স ফ্যাশন হাউস, প্রধান’স ল’ ফার্ম, প্রধান’স হাউস (বর্তমানে হোয়াইট হাউস), এসডি কনসাল্টিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড, ফিশিং কোম্পানি এবং জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিংস অ্যান্ড পেপার্স নামক প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেয়েছে।

সিআইডি সূত্র জানায়, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মানি লন্ডারিং মামলার তদন্তে নেমে এ পর্যন্ত তার নামে একটি মার্কেট (২৪/৮ বছিলা রোড, মোহাম্মদপুর), মোহাম্মদপুর স্বপ্নপুরী হাউজিংয়ে চারটি ফ্ল্যাট, ৭৬/এ পুরানা পল্টনে পাঁচ তলা বাড়ি, মোহাম্মদপুরের আওরঙ্গজেব রোডের ৭/৩ নম্বর বাড়িতে দুই হাজার ২০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে।

১১ অক্টোবর তাকে গ্রেফতারের সময় সাতটি চেক বই, সাত কোটি ৫০ লাখ ৯০ হাজার টাকার চেক ও এফডিআর জব্দ করে র‌্যাব। ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান প্রথম দেড় মাস ছিল ব্যাপক আলোচনায়।

এ সময় ২২টি স্থানে ৩০টি অপারেশন চালায় র‌্যাব। এসব অভিযানে ৯ ভিআইপিসহ ৩২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ২০৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। ২২টি অস্ত্র, টর্চার সামগ্রী, নগদ সাড়ে আট কোটি টাকা ও চার কোটি টাকা মূল্যের আট কেজি স্বর্ণালংকার জব্দ করা হয়।

পৌনে ২০০ কোটি টাকার বেশি এফডিআর-চেক উদ্ধার করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও অভিযান বন্ধ হয়নি। কিন্তু দুই মাসের বেশি সময় ধরে এ সংক্রান্ত কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। ৩১ অক্টোবর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জুকে গ্রেফতারের পর আর কোনো অভিযান দৃশ্যমান হয়নি।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে আত্মগোপনে যাওয়াদের মধ্যে এখনও যারা পলাতক আছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ, যুবলীগের সাবেক নেতা কাজী আনিসুর রহমান, গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু, যুগ্ম সম্পাদক রুপন ভূঁইয়া প্রমুখ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here