খবর৭১ঃ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ শুরু করতে নয়, যুদ্ধ ঠেকাতেই ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার কাসেম সোলেমানিকে হত্যা করা হয়েছে। শুক্রবার বাগদাদে বিমান হামলায় সোলেমানির ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ শেষ হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সন্ত্রাসী হামলায়ও সোলেমানির হাত ছিল বলে তিনি দাবি করেন। শনিবার ফ্লোরিডায় এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প এসব দাবি করেন। সোলেমানিকে হত্যার পর পাল্টা হামলার আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি বড় শহরে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ৬২ বছর বয়সী সোলেমানিকে হত্যার ‘ভয়ংকর বদলা’ নেয়ার হুশিয়ারি দিয়েছে তেহরান।
এসব নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে উত্তেজনা আরও বাড়াবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। এদিকে বাগদাদে শনিবার ইরানপন্থী পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সের (পিএমএফ) ওপর মার্কিন বাহিনী হামলা চালিয়েছে। এতে ছয়জন নিহত হয়েছেন। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে আরও সাড়ে তিন হাজার সেনা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। খবর বিবিসি, এপি ও রয়টার্সের।
ফ্লোরিডার অবকাশযাপন কেন্দ্র মার-আ-লগোয় সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘বিশ্বের এক নম্বর সন্ত্রাসী কাসেম সোলেমানিকে হত্যায় মার্কিন সেনাবাহিনী নির্ভুল অভিযান চালিয়েছে। মার্কিন কূটনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর ভয়াবহ ও নির্মম হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন সোলেমানি, কিন্তু আমরা তাকে ধরে ফেলি ও সরিয়ে দিই।’
ট্রাম্প বলেন, দিল্লি থেকে লন্ডন পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সন্ত্রাসবাদী হামলার ষড়যন্ত্রে সোলেমানি জড়িত ছিলেন। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ শেষ হয়েছে। দিল্লির কোনো হামলার সঙ্গে সোলেমানির সংশ্লিষ্টতা ছিল, তা নির্দিষ্ট করে তিনি বলেননি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ২০১২ সালে ভারতে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর স্ত্রীর গাড়িতে বোমা হামলার দিকে তিনি ইঙ্গিত করেছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরও বলেন, ‘নিরপরাধ মানুষ হত্যাকে সোলেমানি তার বদভ্যাসে পরিণত করেছিলেন। দিল্লি থেকে লন্ডন পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদী চক্রান্তে তার ভূমিকা ছিল। আমরা সোলেমানির অত্যাচারের শিকার হওয়া বহু মানুষের কথা স্মরণ করছি এবং এটা জেনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি যে তার সন্ত্রাসের রাজত্ব শেষ।’
পাল্টা হামলার আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের বড় শহরগুলোয় সতর্কতা : সোলেমানিকে হত্যার পর পাল্টা হামলার আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি বড় শহরে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এসব শহরের বাসিন্দাদের সজাগ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, স্পর্শকাতর জায়গাগুলোয় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী শাদ ওলফ বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যদের সঙ্গে নিয়ে তার দফতর দেশজুড়ে কাজ করছে। এখন পর্যন্ত কোনো হুমকি শনাক্ত না হলেও যে কোনো কিছুর জবাব দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর নিরাপত্তা বাড়ানোর কথা জানিয়ে নিউইয়র্কের মেয়র বিল ড্য ব্লাসিনো বলেছেন, প্রতিশোধ নিতে ইরান বা সন্ত্রাসী মিত্রদের যে কোনো হামলা ঠেকাতে আমেরিকা প্রস্তুত। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, এ হুমকি মোকাবেলায় দীর্ঘদিন সজাগ থাকবে শহর কর্তৃপক্ষ।
নিউইয়র্কের পুলিশ কমিশনার ডারমোট শো বলেন, ইরান ও এ অঞ্চলের সংশ্লিষ্ট ঘটনাপ্রবাহের ওপর নজর রাখছে তার বাহিনী। শহরের ওপর কোনো সুনির্দিষ্ট হুমকি না থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। নগরবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘অন্য সময়ের মতো কিছু দেখলেই আপনারা আমাদের জানান।’
ইরানি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকদের বড় অংশের বাস লস অ্যাঞ্জেলস শহরে। সোলেমানির হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এ শহরে সতর্কতা জারি করা হয়। এ শহরের ওপর বর্তমানে কোনো হুমকি না থাকার কথা জানিয়ে পুলিশ কর্তৃপক্ষ বলেছে, যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্যের জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গেই যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হবে।
ইরাকে মিলিশিয়া কনভয়ে বিমান হামলা নিয়ে বিভ্রান্তি : ইরাকে ইরানপন্থী শিয়া আধা-সামরিক বাহিনীর একটি গাড়িবহরে বিমান হামলা নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। ইরাকের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানায়, সোলেমানিকে হত্যার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মিলিশিয়া বাহিনীর কনভয়ে ফের মার্কিন বিমান হামলা হয়েছে।
বাগদাদের উত্তরে ক্যাম্প তাজির কাছে এ হামলায় পিএমএফের ছয়জন নিহত হয়েছেন। পিএমএফ প্রথমে এক বিবৃতিতে শুক্রবার রাত সোয়া ১টার দিকে বাগদাদের উত্তরে ক্যাম্প তাজির কাছে মার্কিন বিমান হামলায় তাদের বাহিনীর চিকিৎসকসহ দলের ছয় সদস্য নিহত হয়েছেন বলে দাবি করলেও পরে তা প্রত্যাহার করে নেয়।
এদিকে টুইটারে শনিবারের হামলার দায় অস্বীকার করেছেন ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের মুখপাত্র কর্নেল মাইলস ক্যাগিনস থ্রি। মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট ক্যাম্প তাজির কাছে কোনো ধরনের বিমান হামলা চালায়নি বলে তিনি জানান।
যুক্তরাষ্ট্রে সাইবার হামলা চালিয়ে প্রতিশোধ নেবে ইরান : দেশের গুরুত্বপূর্ণ জেনারেল কাসেম সোলেমানিকে হারিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে ইরান। ‘উপযুক্ত সময়ে, যথাস্থানে’ এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ইরানের নেতারা। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, সোলেমানি হত্যাকাণ্ডের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সত্যিকার সাইবারযুদ্ধ শুরু হতে পারে।
সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেহরানের ‘চরম প্রতিশোধের’ হুমকি যুক্তরাষ্ট্রের পাওয়ার গ্রিড, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যাংক এবং যোগাযোগ নেটওয়ার্কের মতো অবকাঠামো খাতে হ্যাকিং হামলার ঝুঁকি বাড়িয়েছে। তেহরানের পারমাণবিক সক্ষমতা কমাতে ২০১০ সালে স্টাক্সনেট কম্পিউটার ভাইরাসের উন্নয়ন ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল।
স্টাক্সনেট হামলার পর নিজেদের সাইবার খাতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে ইরান। সক্ষমতার প্রমাণ দিতে ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে ও ২০১৩ সালে একটি ছোট বাঁধের ওপর সাইবার হামলা চালায় তেহরানের সাইবার যোদ্ধারা। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা ও ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ ব্যবস্থার ওপর হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র।
সাইবার সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠান ফায়ার আইয়ের গোয়েন্দা বিশ্লেষণ বিভাগের পরিচালক জন হাল্টকুইস্টের অনুমান, ইরান ব্যক্তি খাতের ওপর প্রতিশোধে মনোযোগ দিতে পারে। তিনি বলেন, ইরানের হয়তো এখনও কোনো সিস্টেম নষ্ট করার মতো সক্ষমতা নেই। তবে তারা ব্যাপকভাবে তথ্য মুছে দিতে বা সবকিছু আংশিকভাবে থামিয়ে দিতে পারে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দেয়া এক চিঠিতে ইরানের রাষ্ট্রদূত মাজিদ তাখত রাভাঞ্চি বলেছেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আত্মরক্ষার অধিকার তেহরানের রয়েছে।
আমেরিকার মৃত্যু চাই : শনিবার কাসেম সোলেমানির জানাজায় অসংখ্য মানুষ যোগ দেন। বাগদাদে শোক মিছিলে অংশ নেয়া মানুষজন ইরাকি ও মিলিশিয়া বাহিনীর পতাকা বহন করে এবং স্লোগান দেন। তারা বলেন, ‘আমেরিকার মৃত্যু চাই।’ শহরের অনেক রাস্তাজুড়ে মিছিল করা হয়।
তাদের অনেকের হাতে ছিল সোলেমানি এবং ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আল খামেনির ছবি। সোলেমানির মৃত্যুতে ইরান ও ইরাকে তার সমর্থকরা শোক পালনের ঘোষণা দিয়েছে। মঙ্গলবার সোলেমানির লাশ ইরানের নিজ শহর কারমানে দাফন করা হবে।
‘সোলেমানির পরিণতি হবে নাসরাল্লাহ, আসাদ ও পুতিনের’ : সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে যুদ্ধে আসাদ সরকারকে সোলেমানি সহযোগিতা করেছিলেন। এ কারণে তার মৃত্যুতে সিরিয়ার ইদলিবের জনগণ উল্লসিত। কেউ কেউ আশা করছেন, আগামী দিনে সোলেমানির মতো হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভাদিমির পুতিনের একই পরিণতি হবে।
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আইএসের পরাজয়ে সিরীয় বিদ্রোহীদের দমনেও কুদস ফোর্সের বড় ভূমিকা ছিল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অভিযানের মুখে সিরীয় বিদ্রোহীরা আশ্রয় নেন ইদলিবে। রাশিয়া ও ইরানের প্রত্যক্ষ সমর্থনে এপ্রিলে ইদলিবে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন আসাদ। এ অভিযানে সহস্রাধিক মানুষ নিহত হয়। দুই লাখের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।