খবর৭১ঃ নদীতীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে ২০১৯ সালের আগেও বহুবার অভিযান পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। কিন্তু মাত্রই শেষ হওয়া ২০১৯ সালের মতো আর কখনো এমন নিরাপোষ ও প্রত্যয়ী দেখা যায়নি সরকারি সংস্থাটিকে। তারা এ বছর বড় প্রভাবশীলী এমনকি সরকারি সংস্থার দখলে নেওয়া নদীর জায়গা উদ্ধার করেছে স্থাপনা ভেঙে দিয়ে। কোনো বাধাই তাদের উচ্ছেদ অভিযানে দমাতে পারেনি। তাদের এই উদ্যমী কার্যক্রম প্রশংসা পেয়েছে সবার।
নানা বাধা, আঘাত আর চড়াই-উতরাই সদম্ভে মাড়িয়ে পার হওয়া বছরকে ঢাকার নদী উদ্ধারের জন্য ‘সর্বজনীন প্রত্যয়ের বছর’ আখ্যা দিয়েছেন সংস্থাটির যুগ্ম পরিচালক (ঢাকা নদীবন্দর) এ কে এম আরিফ উদ্দিন।
বছরব্যাপী অভিযানে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীর দুই তীরের অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়ে উদ্ধার করা জায়গায় স্থায়ী সীমানা খুঁটি স্থাপনের কাজ চলছে।
গত বছরের ২৯ জানুয়ারি বুড়িগঙ্গা নদীর খোলামোড়া ঘাট থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে বিআইডব্লিউটিএ। প্রথমে চার পর্বে ৫০ দিন অভিযান পরিচালিত হয়। এ সময় পুরান ঢাকার প্রভাবশালী সাংসদ হাজী সেলিম, দুদকের আইনজীবী, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের গোদাম, আমিন মোমিন হাউজিংসহ বেশ কিছু প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এই অভিযানে সব মিলিয়ে উচ্ছেদ করা হয় ৪ হাজার ৭৭২টি অবৈধ স্থাপনা।
বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীর উভয় তীর মিলিয়ে মোট ১৫৭ কিলোমিটার তীরভূমিতে চালানো অভিযানে উদ্ধার হয় ১২১ একর জায়গা। উচ্ছেদকৃত স্থাপনার মধ্যে রয়েছে ৭২৫টি পাকা স্থাপনা, ৯৮৬টি আধাপাকা স্থাপনা, ৩২১টি সীমানা প্রাচীর ও অন্যান্য দুই হাজার ৭৪০টি স্থাপনা।
উচ্ছেদ, উদ্ধার অভিযানে বাধার ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। হামলা হয়েছে অভিযান পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমানের ওপর। অভিযানকালে এবং অভিযানের পর নদী খনন করার সময় একাধিকবার হামলার শিকার হয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। হামলার পাশাপাশি মেশিনপত্র ভাঙচুর করেছে দখলদারদের লোকজন। এসব ঘটনায় ৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বিআইডব্লিউটিএ।
হামলা, ভাঙচুর ছাড়াও উচ্ছেদকৃত তীরভূমির কিছু অংশ আবার দখলে নেওয়ার সাহসও দেখিয়েছে দখলদাররা। উচ্ছেদ করা জায়গায় পুনরায় গড়ে তোলা হয় পাকা স্থাপনা। বিআইডব্লিউটিএও ছাড়বার পাত্র নয়। তুরাগতীরে আবার বিশেষ অভিযানে নামে সংস্থাটি।
বছরব্যাপী ঢাকা নদীবন্দরে প্রায় ছয় হাজার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে বলে সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, যা এখন পর্যন্ত দেশের কোনো সংস্থার মাধ্যমে সবচেয়ে বড় অভিযান হিসেবে খ্যাত।
উচ্ছেদের পাশাপাশি দখলদারদের আটক, দখলে বাধা প্রদানকারীদের দ-, জরিমানা করা হয়। আর উচ্ছেদকৃত মালামাল বিক্রি করা হয় নিলামে।
তবে অভিযানের এক বছরে আদি বুড়িগঙ্গার চ্যানেল দখলমুক্ত করা সম্ভব না হলেও তুরাগ চ্যানেল উদ্ধার করে সেখানে পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনা গেছে। এ বিষয়ে আরিফ উদ্দিন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আদি বুড়িগঙ্গার চ্যানেল আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, এটা নিয়ে আমার মধ্যে একটা কষ্ট কাজ করে।’
দীর্ঘ এই প্রক্রিয়াকে প-শ্রমে পরিণত করতে চান না এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘আমাদের যুদ্ধটা এখন মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। নইলে আমরা এখন যে কাজটা করে যাচ্ছি, সেটা ব্যর্থতায় পরিণত হবে। অর্ধেক কাজ কোনো কাজ না। আমরা যদি এখানে থেমে যাই, তাহলে এটা প-শ্রম হবে। যেকোনো মূল্যে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’
সীমানা নির্ধারণ হলে অবৈধ স্থাপনা সহজে নির্ণয় করা যাবে উল্লেখ করে আরিফ উদ্দিন বলেন, তাই সীমানা পিলার স্থাপনের কাজটি এগিয়ে নিতে হবে। এ ছাড়া নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা বৃদ্ধি এবং নদীকে দূষণমুক্ত করা- এই কাজগুলো আমাদের করতে হবে।’
অভিযানের শুরু দিকে তুরাগ নদে ‘আমিন মোমিন হাউজিং’য়ে উচ্ছেদ চলাকালে হঠাৎই আরিফ উদ্দিনকে উচ্ছেদস্থল থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। আলোচনা ওঠে তাকে বদলি করা হবে। যদিও তেমনটি ঘটেনি। আবার তাকে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। এমনটি জানালেন সংস্থাটির এই যুগ্ম পরিচালক। বলেন, ‘এখন চারদিকে অনেক ষড়যন্ত্র চলছে। আমাদের সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। যদি আমি এই পদে থাকি, তাহলে আগামী ১ বছরে এই যুদ্ধটা আমি করতে চাই।’
বিশাল এই কর্মজজ্ঞের কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী এবং নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের বলে জানান আরিফ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এই কাজের কৃতিত্বটা আমাদের নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। তার সদিচ্ছা, দৃঢ়তা না থাকলে এটি সম্ভব হতো না। এই অভিযানে অনেক বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছে করেছি। কাউকে কিন্তু বাদ দেয়া হয়নি। তারপরেও আমরা টিকে আছি। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আছেন। আমরা যদি ব্যক্তিগত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থাকি, তাহলে সরকার চাইলে সবকিছু সম্ভব।’
২০১৯ সালে সংস্থাটির কর্মকা- জনগণের কাছে তুলে ধরায় গণমাধ্যমে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান আরিফ উদ্দিন।
বিআইডব্লিউটিএ ঢাকা নদীবন্দরে উচ্ছেদ শুরু করার পর এর দেখাদেখি চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতেও উচ্ছেদ শুরু হয়। এরপর পানি উন্নয়ন বোর্ড, নদী কমিশনও মাঠে নামে। বেহাত হওয়া জায়গা উদ্ধারে কাজ করতে দেখা যায় বিভিন্ন সংস্থাকে।
অভিযানের পর তীরভূমি সংস্কার করে ১০ হাজার সীমানা খুঁটি স্থাপনের কথা রয়েছে। ১০০ বছরের গ্যারান্টিযুক্ত প্রতিটি খুঁটির পেছনে খরচ হচ্ছে সাড়ে তিন লাখ টাকা। ১০ হাজার খুঁটির মধ্যে ৩ হাজার ৮০৩টি বসবে ঢাকা নদীবন্দর এলাকার। এ কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। বছর শেষ হওয়া পর্যন্ত ২০৭টি খুঁটি স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে।
নদীর নাব্যতা নদীকে ফিরিয়ে দিতে ড্রেজিং, তীরভূমি অংশকে সংরক্ষণ এবং ঢাকাবাসীর জন্য নদীকে বিনোদনের জায়গা হিসেবে পরিচিত করতে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে নদীর পাড় বাঁধাই, ওয়াকওয়ে নির্মাণ, সবুজায়ন, লাইটিং এবং ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণের কথা রয়েছে