খবর৭১ঃ রোহিঙ্গা মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুদের যথেচ্ছ গ্রেফতার, নির্যাতন, ধর্ষণ, হেফাজতে মৃত্যুসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করেছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। রোহিঙ্গা ও অন্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে উত্তেজনা প্রশমনে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় প্রস্তাবটিতে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের যুদ্ধাপরাধ তদন্ত করে দেখার জন্য তহবিল বরাদ্দ করেছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। জাতিসংঘ ৩০৭ কোটি ডলারের এ তদন্ত তহবিলে প্রথমবারের মতো সিরিয়া ও মিয়ানমারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শুক্রবার ৫২তম অধিবেশনে আনা নিন্দা প্রস্তাবে জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ১৩৪টি দেশ, আর বিপক্ষে ভোট পড়ে নয়টি। ভোটদানে বিরত ছিল ২৮টি দেশ। ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরুর পর থেকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে এ পর্যন্ত তিনটি প্রস্তাব পাস হল।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাস হওয়া কোনো প্রস্তাব দেশটি মানতে বাধ্য না হলেও বিশ্ব মতামতের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রস্তাব প্রভাব ফেলে থাকে। ১৪ নভেম্বর জাতিসংঘের থার্ড কমিটি অধিকাংশ সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থনে এই প্রস্তাবটি অনুমোদন পেয়েছিল। প্রস্তাবটি পাসের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে আন্তর্জাতিক মহলের সার্বিক সমর্থনের বিষয়টি পুনরায় দৃশ্যমান হল বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা। তবে মিয়ানমারের দাবি, উগ্রবাদীদের দমন করতে তাদের এসব অভিযান। নভেম্বরে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মামলা করে গাম্বিয়া, যে শুনানিতে হাজিরা দিয়েছেন দেশটির নেত্রী অং সান সু চি।
মিয়ানমারে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে রোহিঙ্গা মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের যেসব তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছিল একটি স্বাধীন তদন্ত দল, সেগুলোও তুলে ধরা হয় নিন্দা প্রস্তাবে। সেসব ঘটনাকে আন্তর্জাতিক আইনে চরম অপরাধ বলে মিশনটি বর্ণনা করেছিল। এই প্রস্তাব অনুমোদনের পর জাতিসংঘে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হাও দো সুয়ান একে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের নামে আরেকটি বৈষম্যমূলক ও বিশেষভাবে বাছাই করার দ্বৈত আচরণ’ বলে বর্ণনা করেছেন, যার মাধ্যমে মিয়ানমারের রাজনৈতিক চাপ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে তার অভিযোগ।
তিনি বলেছেন, এই প্রস্তাবটি রাখাইন রাজ্যে জটিল পরিস্থিতি সমাধানে কোনো ভূমিকা রাখবে না। এই প্রস্তাব সেখানে ‘অবিশ্বাসের বীজ বপন’ করবে বলে তিনি বলছেন। তার মতে, এটি ওই অঞ্চলে নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে আরও মেরুকরণ তৈরি করবে।
জাতিসংঘের ওই প্রস্তাবে চার দশক ধরে প্রতিবেশী বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার ব্যাপারে সতর্কবার্তা তুলে ধরা হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বাঙালি হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। যদিও কয়েক প্রজন্ম ধরে তারা দেশটিতে বসবাস করছেন। ১৯৮২ সালে তাদের নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করেছে বৌদ্ধসংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটি। এরপর থেকে রোহিঙ্গারা মূলত রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েছেন। চার দশক ধরেই রোহিঙ্গা মুসলিম সহিংসতার মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর মধ্যে ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর দমনপীড়ন অভিযান চালানোর পর থেকেই এসেছে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ থেকে কয়েকবার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা হলেও মিয়ানমারে নিরাপদ পরিবেশের অভাবে ফিরতে রাজি হয়নি রোহিঙ্গারা। বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে ১১ নভেম্বর আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজে) মামলা করে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। এর শুনানি শেষ হয়েছে। এখন রায়ের অপেক্ষা। আইসিজেতে এই বিচারের মধ্যে জাতিসংঘের সাধরণ অধিবেশনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নতুন এ প্রস্তাব পাসের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।