খবর৭১ঃ
মিজানুর রহমান মিলন, সৈয়দপুর থেকেঃ সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিদ্যুৎ বিভাগে চাকরি করতেন গমির উদ্দিন। পরিবার নিয়ে থাকতেন নীচু কলোনি রাইস মিল এলাকার রেল কোয়াটারে (বর্তমানে সেনানিবাস এলাকা)। পৈত্রিক বাড়ি কয়া মিস্ত্রিপাড়া বসুনিয়া সড়কস্থ পুলপাড়ায়। তার বাবার নাম মরহুম আসমত মামুদ। রেলওয়ে শহীদ স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ রয়েছে তার নাম। বিজয়ের মাত্র দুইদিন আগে তাকে হত্যা করে পাকিস্তানের পক্ষে থাকা সৈয়দপুরের উর্দূভাষীরা।
ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ তাকে আন্দোলনমুখি করে তোলে। পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গতে তিনি নিয়মিত আওয়ামী লীগের মিটিং-মিছিলে অংশ দিতেন। জয় বাংলা স্লোগান তার শিরা উপশিরায় ধনিত হতো। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর সৈয়দপুরে উর্দুভাষী বিহারী আর বাঙালিদের মধ্যে চরম উত্তেজনা ছড়াতে থাকে। এ অবস্থায় তিনি ২২ মার্চ রেল কোয়াটার ছেড়ে শহরের কাজীপাড়া এলাকায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অবস্থান নেন। এরপর দেশে যুদ্ধ শুরু হলে খানসেনাদের সহায়তায় উর্দুভাষী বিহারীরা কাজীপাড়া এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এ সময় তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে পালাতে গিয়ে খানসেনাদের গুলিতে মারা যায় ৯ বছর বয়সী ছেলে মজিবর রহমান। পরে তার লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমন অবস্থায় সন্তান হারিয়ে গমির উদ্দিন পাগল প্রায় অবস্থায় তিন মেয়ে মনোয়ারা (৭), আনোয়ারা (৫), হাজরা (৩) ও এক বছর বয়সী ছেলে আনোয়ার ও স্ত্রীকে নিয়ে পার্বতীপুর উপজেলার চাকলার হাটে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নেন। যুদ্ধকালীন সময়ে মেজো মেয়ে আনোয়ারাও মারা যায়।
বেঁচে থাকা পরিবারের অন্য সদস্যদের মুখে আহার যোগাতে দিনের বেলা মজুরের কাজ করেছেন। আর রাতের বেলা যুবকদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করতেন। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। এমন খবরে গমির উদ্দিনের হৃদয়ের স্পন্দন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনেক গুণ বেড়ে যায়। এমন অবস্থায় রেল শ্রমিক গমির উদ্দিন ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সকাল বেলা কাজীপাড়া হয়ে শহরে ঢুকে ১নং ঘুমটি এলাকায় আসে। এই সময় দেখা হয় দীর্ঘদিনের সহকর্মী উর্দুভাষী জামালের সঙ্গে। পরে জামালের সঙ্গে থাকা আরো কয়েকজন উর্দুভাষী অত্যন্ত সুকৌশলে তাকে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ভিতরে নিয়ে যায়। সেখানেই গমির উদ্দিনকে তার সহকর্মী বন্ধুরা খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে। এরপর কামারশালের জ্বলন্ত চুলায় নিক্ষেপ করে অঙ্গার করে দেয়।
এসব তথ্য মিলেছে বর্তমানে বেঁচে থাকা তার মেয়ে হাজরার সঙ্গে কথা বলে। বড় মেয়ে মনোয়ারাও ইতোমধ্যে মারা গেছে। গতকাল বুধবার রেল শ্রমিক শহীদ গমির উদ্দিনের উত্তরসুরি হাজরার সঙ্গে কথা হয় শহীদ আজিজার রহমান স্ট্রীটের ইসমাইল মাছুয়া লেনের ভাড়া বাসায়। তিনি ক্ষোভ ঝেড়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, যে দেশের জন্য বাবা জীবন দিলেন, ভাই-বোন মারা গেল। সেই দেশে আমরা তার উত্তরসুরিরা আজও গৃহহীন হয়ে আছি। দেশ বিজয়ের ৪৮ বছরেও মিলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এমনকি শহীদ সন্তান হিসাবে সুযোগ-সুবিধা পাওয়াতো দূরের কথা সরকার পক্ষ থেকে কেউ কোনদিন খোঁজও নেয়নি। অথচ মুক্তিযুদ্ধে আমরা বাবা, ভাই ও বোন তথা পরিবারের তিন সদস্য হারিয়েছি। শুধুমাত্র শহীদ রেল শ্রমিকদের স্মৃতিফলকে বাবার নাম ১৪৯ নম্বরে লেখা রয়েছে।
শহীদ গমির উদ্দিনের মেয়ে হাজরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তাদের মাথাগোঁজার ঠাঁই করে দিতে বিনীত নিবেদন জানিয়েছেন। তবে শহীদ গমির উদ্দিনের স্মৃতি রক্ষার্থে তার চাকরি জীবনের একাধিক সহকর্মীসহ বিশিষ্টজনরা শহরের মিস্ত্রিপাড়া মোড় থেকে বসুনিয়া পাড়া যাওয়ার রাস্তাটির নাম শহীদ গমির উদ্দিন সড়ক নামকরণের দাবি জানিয়েছেন।