শুধু শিল্পঋণে ৯ শতাংশ সুদ বাধ্যতামূলক

0
446
শুধু শিল্পঋণে ৯ শতাংশ সুদ বাধ্যতামূলক

খবর৭১ঃ বাতিল হচ্ছে ব্যাংকের সুদের হার কমানোর ‘নয়-ছয় ফর্মুলা’। এর পরিবর্তে নতুন পদ্ধতিতে শুধু শিল্পঋণের সুদ ৯ শতাংশ বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। আর আমানতের সুদহার নির্ধারণ করবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ সংক্রান্ত নির্দেশ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে শিগগির প্রজ্ঞাপন জারি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

এদিকে কোন কোন ব্যাংক সিঙ্গেল ডিজিটের নির্দেশনা অমান্য করেছে, তা খুঁজে বের করতে সব ব্যাংকে বিশেষ পরিদর্শন পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই পরিদর্শনে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ৮ ব্যাংক ছাড়া বেসরকারি প্রায় সব ব্যাংকই কোনো-না-কোনোভাবে সিঙ্গেল ডিজিটের নির্দেশনা অমান্য করার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সূত্র জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামান, আহমেদ জামাল, নির্বাহী পরিচালক আবু ফরাহ মো. নাসেরসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা। বৈঠকে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘নয়-ছয় ফর্মুলা’ ভুলে যান। এখন থেকে ব্যাংকিং খাতে আমানতে ৬ এবং ঋণে ৯ শতাংশ সুদ হারের ফর্মুলা থাকবে না। নতুন পদ্ধতিতে সুদের হার কমানো হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক কত শতাংশে আমানত নিল তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। তবে এখানে ব্যবসা করতে হলে শুধু শিল্পঋণে সুদের হার ৯ শতাংশের বেশি এক পয়সাও নেয়া যাবে না। এটার ভিত্তিতে দ্রুত প্রজ্ঞাপন জারি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, শিল্পঋণে ৯ শতাংশ সুদ কার্যকর সংক্রান্ত যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে, সেখানে চলতি মূলধন ঋণ, প্রজেক্ট লোনসহ শিল্প খাতের বড় ঋণগুলো থাকবে। তবে ভোক্তাঋণ এর আওতায় পড়বে না। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রজ্ঞাপনটি আগামী সপ্তাহের প্রথমদিকে জারি করা হতে পারে।

আরও জানা গেছে, ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশের মধ্যে বা সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ এখনও মানছেন না বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মালিকরা। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ৭ বার এবং বর্তমান ও সাবেক অর্থমন্ত্রী ৯ বার নির্দেশনা দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও চেয়ারম্যানদের ডেকে এ ব্যাপারে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। সুদের হার কমানোর শর্তে ব্যাংকগুলোকে ৫ ধরনের বিশেষ ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কিন্তু এসব সুবিধা নিয়েও তারা সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামাননি।

সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে এনেছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর দু-একটি ছাড়া বাকি সব ব্যাংকের ঋণের সুদের হারই ডাবল ডিজিটে রয়েছে। বেশিরভাগ ব্যাংকে শুধু ডাবল ডিজিট নয়, সীমার বাইরে সুদ কষা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৪ মে গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী প্রথমবারের মতো ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। তাকে লক্ষ্য করেই তিনি এ নির্দেশ দেন। পরে সে নির্দেশ অনুযায়ী তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ঋণের সুদের হার কমাতে নানামুখী উদ্যোগ নেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দেয়া হয়। এর আলোকে অর্থমন্ত্রী চিঠি দেন বাংলাদেশ ব্যাংককে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করে ঋণের সুদের হার কমানোর জন্য তাদের বার্তা দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর এ বার্তা কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদও ব্যাংকের পরিচালকদের দেন। এর আলোকে গত বছরের ২০ জুন বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভায় সব ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশে এবং ছয় মাস মেয়াদি আমানতের সুদ হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়া হয়। সুদের এই হার তারা গত বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর করার কথা জানায়। কিন্তু ১ জুলাই থেকে এ সিদ্ধান্ত সরকারি চার ব্যাংক ছাড়া কোনো ব্যাংকই কার্যকর করেনি। সুদের হার ৯ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত কার্যকর না হওয়ায় গত বছরের ২ আগস্ট সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ব্যাংকের এমডি-চেয়ারম্যানদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন।

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আজ (২ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ এবং ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ হবে। আগামী ৯ আগস্ট থেকে সবাইকে এ নির্দেশ কার্যকর করতে হবে।’ কিন্তু গত বছরের সে নির্দেশ এখনও কার্যকর হয়নি।

সরকারের বর্তমান মেয়াদে গত ৩১ মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় শিল্পপণ্য মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি মনে করি, আমাদের দেশে শিল্পায়নের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ব্যাংক ঋণ। ব্যাংকের ব্যাপারটা আমরা দেখছি। কয়েকদিন আগে আমরা বসেছিলাম, কীভাবে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানো যায়। আমরা চেষ্টা করেছি। একবার উদ্যোগ নিলাম, সঙ্গে সঙ্গে কথাও বললাম। বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধাও করে দিলাম। যেমন: আগে আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানের ৭০ ভাগ অর্থ সরকারি ব্যাংকে, ৩০ ভাগ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা হতো।’

ব্যাংক মালিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘এটা যদি ফিফটি-ফিফটি করে দেয়া হয় তাহলে আমরা ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনব। সেটাও কিন্তু করে দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম এবং দিলাম। কিছু ব্যাংকে ঠিকই সুদের হার ৯ শতাংশে নামানো হল, কিন্তু সবাই তা করল না। পরে আবার বাড়াতে বাড়াতে ১৪, ১৫, ১৬ শতাংশে নিয়ে গেল। তিনি ব্যাংক মালিকদের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, কেন করল না, তাদের এই সুযোগটা দেয়া সত্ত্বেও?’

গত ১২ এপ্রিল ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সঙ্গে বৈঠক করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ব্যাংকের ভালো গ্রাহকদের ক্ষেত্রে এক অঙ্কের ঋণসীমা থাকবে না। এটা তুলে দেয়া হবে। ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হবে। ফলে ভালো গ্রাহকরা চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাবেন।’

অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেয়ার পর দু’দফায় ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠকে ঋণের সুদের হার কমানোর উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেন। প্রাক-বাজেট আলোচনায় গত ২৬ এপ্রিল তিনি বলেছেন, ‘একটি বিষয় সবাইকে স্বীকার করতে হবে যে, বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণের সুদের হারের মতো পৃথিবীর কোনো দেশে এত বেশি সুদহার নেই। এই সুদহার ১৪, ১৫, ১৬ ও ১৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। এত বেশি সুদ দিয়ে কোনোদিন শিল্পকারখানা টিকে থাকতে পারে না। আমি নিজেও এক সময় ব্যবসায়ী ছিলাম। আমারও কিছু কারখানা ছিল। আমি নিজেও সুদ দিতে পারিনি। ব্যাংকের ঋণ নিয়ে সুদ দিতে পারে- এমন নজির থাকে না। কারণ, সুদের হার বেশি ও ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা।’

গত ১৩ জুন চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটের ওপরে দেখতে চাই না।’ সুদের হার কমাতে ও খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি ঠেকাতে ব্যাংকিং খাতে ৬ দফা সংস্কার কর্মসূচির ঘোষণা দেন তিনি।

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে গত ১৪ জুন প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ঋণের সুদের হার কমানোর কথা বলে বেশ কয়েক দফা সুবিধা নিয়েছে মালিকপক্ষ। কিন্তু তারা সুদের হার কমায়নি। কেন কমায়নি সেটা আমরা দেখব। যারা কমায়নি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব। সুদের হার বেশি হলে ব্যবসা-বাণিজ্য করা যায় না। বিনিয়োগ বাড়ে না। সুদের হার অবশ্যই সিঙ্গেল ডিজিটে নামাতে হবে।’

গত ২৯ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ঋণের সুদের হার অবশ্যই সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে হবে।’

গত ১ সেপ্টেম্বর রফতানি ট্রফি বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের ব্যাংক থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিতে হয়। এতে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এই সমস্যা দূর করতে আমরা ইতিমধ্যে ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছি।’

৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এমডি-চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠক করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমানতের সুদের হার ৬ শতাংশ এবং ঋণের সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। এটি ব্যাংকগুলোকে মানতে হবে। না মানলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সার্কুলার জারি করে দেয়া হবে।’

৪ সেপ্টেম্বর সরকারি ক্রয় ও অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ঋণের বিপরীতে জ্যামিতিক হারে সুদ আরোপ করার সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে। সরকার যেভাবে বলবে, সেভাবে ঋণের সুদের হার নির্ধারণ করতে হবে। সরকারের নির্দেশ না মানলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে।’

সর্বশেষ গত ৫ নভেম্বর একনেক বৈঠকের অনির্ধারিত আলোচনায় ঋণের সুদ এক অঙ্কে না নামায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন তিনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অর্থমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন। সে নির্দেশের পরই ২৬ নভেম্বর গভর্নর ফজলে কবিরকে ডেকে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী। সে নির্দেশনার ভিত্তিতে সুদের হার নিয়ে নতুন ফর্মুলায় প্রজ্ঞাপন জারি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here