খবর৭১ঃ বাংলাদেশ থেকে গত ৫ বছরে যেসব প্রভাবশালী অর্থ পাচার করে সিঙ্গাপুরে ক্যাসিনো ব্যবসায় লগ্নি ও জুয়া খেলেছেন তাদের শনাক্তে নেমেছে দুদক। এদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে সিঙ্গাপুর সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
বৃহস্পতিবার দুদকের মহাপরিচালক (মানি লন্ডারিং) এএনএম আল ফিরোজ এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠিয়েছেন। সিঙ্গাপুরের দুর্নীতি দমন ব্যুরো (সিপিআইবি) প্রধান উয়ং হং কুনের মাধ্যমে সরকারের কাছে এ চিঠি পাঠানো হয়।
এ ছাড়া অনুসন্ধান ও তদন্তের প্রয়োজনে একটি বিশেষ টিম শিগগির সিঙ্গাপুর যেতে পারে বলে জানা গেছে। খবর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রের।
এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, যারা অবৈধ পন্থায় অর্থ বানিয়ে দেশে সম্পদ গড়েছেন বা দেশের বাইরে পাচার করেছেন তাদের বিরুদ্ধে আমাদের টিম কাজ করছে। কারও মুখ দেখে দুদক তদন্ত পরিচালনা করছে না।
যার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসছে, অনুসন্ধানে সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেই মামলা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে টিমের সদস্যরা বিভিন্ন সংস্থায় চিঠিপত্র আদান-প্রদান করছেন। এটি চলমান কার্যক্রমেরই অংশ। কেউ দুর্নীতি করে পার পাবে না বলেও জানান তিনি।
সিঙ্গাপুর সরকারের কাছে দেয়া দুদকের চিঠিতে বলা হয়েছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করে চলেছে। এর অংশ হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করেছে।
দুদকের কাছে তথ্য আছে, বাংলাদেশের অনেক লোক অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জনের পর তা পাচার করেছে। সংস্থাটির অনুসন্ধান-তদন্তেও অবৈধ পথে অর্জিত অর্থ সিঙ্গাপুরসহ বেশ কিছু দেশে পাচারের তথ্য উঠে এসেছে।
এভাবে সম্পদ অর্জনকারীদের মধ্যে অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, সিঙ্গাপুরে হুন্ডিসহ অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। একই সঙ্গে সিঙ্গাপুরে ক্যাসিনোয় লগ্নিসহ জুয়া খেলায় এসব অর্থ তারা ব্যবহার করেছেন।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দুদকের সঠিক অনুসন্ধান ও তদন্তের স্বার্থে সিঙ্গাপুরের ‘মেরিনা-বে’ এবং সে দেশের অন্যান্য স্থানের ক্যাসিনোগুলোয় যারা জুয়া (গ্যাম্বলিং) খেলেছে পাসপোর্ট নম্বরসহ তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা খুবই প্রয়োজন।
সিঙ্গাপুরের ক্যাসিনোগুলোতে বাংলাদেশিসহ বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে যারা জুয়া খেলেন, তাদের পাসপোর্ট অবশ্যই জমা দিতে হয়।
সে কারণে বাংলাদেশের কতজন নাগরিক তাদের পাসপোর্ট জমা দিয়ে গত ৫ বছরে ক্যাসিনো-জুয়া খেলায় অংশ নিয়েছেন তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা দুদককে সরবরাহ করতে চিঠিতে অনুরোধ জানানো হয়।
এতে বলা হয়, জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের ৪৮ ধারার বিধান অনুযায়ী দুদক সিঙ্গাপুর থেকে এ তথ্য পেতে কোনো বাধা নেই। দুই দেশের দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা (বাংলাদেশের দুদক ও সিঙ্গাপুর দুর্নীতি দমন ব্যুরো) একই লক্ষ্যে কাজ করছে।
যৌথভাবে দুর্নীতি নির্মূলে একে অপরকে সহযোগিতার কথা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। দুর্নীতিগ্রস্ত ওইসব লোক ও তাদের অবৈধ কার্যক্রম থেকে দু’দেশকে নিরাপদ রাখার স্বার্থে সিঙ্গাপুর দুদককে সহায়তা করবে বলে চিঠিতে আশা প্রকাশ করা হয়।
সরকার ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে রাজধানীতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্য দিয়ে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করে আসছে। এতে অনেকের সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে আসছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সম্রাট, খালেদ, জি কে শামীমসহ ২২৪ জনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এদের অধিকাংশই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে কমিশন বাণিজ্য, অনিয়ম-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও দখলবাজি, ক্যাসিনো পরিচালনা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, মাদক ব্যবসাসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িত। দুর্নীতি করে অনেকে শত শত কোটি টাকা কামিয়ে দেশের বাইরে পাচার করেছেন।
দেশে তাদের কি পরিমাণ সম্পদ আছে তা প্রথম দফায় খুঁজে বের করার কার্যক্রম চলছে। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতেও নানাভাবে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া যুবলীগের সাবেক সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদ্যবিদায়ী সভাপতি মোল্লা কাউসার ও তাদের পরিবারের সদস্য, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির ১২ কাউন্সিলরসহ শতাধিক ব্যক্তির অবৈধ সম্পদের বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান করছে।
এদের মধ্যে পঙ্কজ দেবনাথ, মোয়াজ্জেম হোসেন রতনসহ ৫ এমপিও আছেন। তাদের অবৈধ সম্পদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে।
দুদকের একটি সূত্র জানায়, অনুসন্ধান ও তদন্তের প্রয়োজনে একটি বিশেষ টিম শিগগির সিঙ্গাপুর যেতে পারে। ওই দেশে এখন কারা অবস্থান করছেন, কারা কত সম্পদ পাচার করেছেন, কত সম্পদ গড়েছেন সরেজমিন তদন্তের জন্য ওই টিম যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কমিশনের অনুমোদনের পরই তারা সে দেশে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার যেসব তথ্য চেয়ে সিঙ্গাপুর সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছে সেই তথ্য ই-মেইলে পাওয়া যাবে এমনটি আশা করছে দুদক। কিন্তু তা পেতে যদি দেরি হয় তবে টিমের সদস্যরা সরাসরি গিয়ে সেই তথ্য নিয়ে আসবেন।
অর্থ পাচার রোধে ৪ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের কমিটি: এদিকে অর্থ পাচার ঠেকাতে দুদকের মহাপরিচালক (প্রশাসন), পরিচালক (প্রশাসন ও মানবসম্পদ), উপ-পরিচালক (অনিষ্পন্ন সেল) এবং সহকারী পরিচালক (মানবসম্পদ) সমন্বয়ে ৪ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের টিম গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এই টিম দুদকের চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে অনুসন্ধান ও তদন্তের যে টিম কাজ করছে তার বাইরে অর্থ পাচারের বিষয়ে কাজ করবে। দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত স্বাক্ষরিত ৩১ অক্টোবরের এক চিঠির মাধ্যমে এই টিম গঠন করা হয়।
টিমকে তিনটি কর্মপরিধি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এগুলো হল : মানি লন্ডারিং সম্পর্কিত বিদ্যমান আইন, বিধিবিধান এবং ২০১৬ সালের মিউচুয়াল ইভ্যালুয়েশন রিপোর্ট (এমইআর) পর্যালোচনা করে সুনির্দিষ্ট সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।
কমিটি প্রয়োজনে যে কোনো বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ করতে পারবে এবং এ প্রতিবেদন বাংলা ও ইংরেজিতে করতে হবে।