মানবতাবাদী একটি রাষ্ট্রের একজন লিভার বিশেষজ্ঞের প্রশ্ন

0
688
মানবতাবাদী একটি রাষ্ট্রের একজন লিভার বিশেষজ্ঞের প্রশ্ন
ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল), অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

খবর৭১ঃ

কক্সবাজারে যাওয়ার জন্য আমার কোনো উপলক্ষ লাগে না। সুযোগের খোঁজে থাকি, আর সুযোগ পেলেই দেই ছুট!  কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে পুরাতন রাস্তা ধরে, শৈবাল হয়ে কলাতলী আর লাবনী পয়েন্টের হোটেল আর দোকানগুলো এত বেশি চেনা যে মনে হয় বোধহয় বাসার আশেপাশের কোনো হোটেল বা দোকান যেন। কক্সবাজারে গেছি নানা কারণেই। পর্যটন থেকে শুরু করে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে লেকচার কি না? কিন্তু গবেষণার তাগিদে কক্সবাজারে যেতে হবে আর যাই হোক এটা মাথায় আসেনি কোনোদিনও। শেষমেষ অবশ্য সেটাই করতে হলো।

রোহিঙ্গাদের দলে-দলে এদেশে আসার আগে থেকেই আমাদের লিভার বিশেষজ্ঞদের একটা ধারণা ছিল যে এদের মধ্যে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের প্রার্দুভাবটা একটু বাড়াবাড়ি রকমেরই বেশি। রোহিঙ্গা সংকট শুরুর আগে বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের মধ্যে ‘২৪ ঘন্টার ভিসার’ একটা বিষয় ছিল। এক দেশের নাগরিকরা টেকনাফ সীমান্তে পাসপোর্ট দেখিয়ে অন্য দেশে ২৪ ঘন্টার জন্য ঘুরে আসার বিশেষ ভিসা পেতেন। আর এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরেই তাদের চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম আর কক্সবাজারে আসা যাওয়া করতেন। ওই দুই জায়গায় আমাদের যেসব সহকর্মীরা আছেন তাদের কাছেই শোনা যে, এদের মধ্যে অনেকেই হেপাটাইটিস সি ভাইরাস নিয়ে তাদের কাছে আসতেন। আর এবার যখন রোহিঙ্গারা দলে দলে ঢুকে পড়লেন, তার পরপরই এই দুই জায়গার বিশেষজ্ঞ আর হাসপাতালগুলো থেকে আমরা এর সমর্থনে তথ্য পেতে থাকি। আর তখনই মাথায় আসে একটা রিসার্চ প্রজেক্টের কথা।

মানবতাবাদী একটি রাষ্ট্রের একজন লিভার বিশেষজ্ঞের প্রশ্ন
টেকনাফের রোহিঙ্গাক্যাম্প । ছবিঃ খবর৭১।

হেপাটাইটিস সি লিভারের অন্যতম ঘাতক ব্যাধি। লিভার সিরোসিস এমনকি লিভার ক্যান্সারেরও এটি অন্যতম কারণ। এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলটা ছেড়ে দিলে পৃথিবীজুড়ে বেশিরভাগ মানুষই লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এই হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের কারণেই। এদেশের মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় আমার লেখাপড়া আর এখানের আলো-বাতাসে আমার বেড়ে উঠা। একজন লিভার বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি মনে করি এদেশের মানুষ আর তাদের লিভারের প্রতি আমার একটা দায়বদ্ধতার জায়গা আছে। সেই তাগিদ থেকেই উদ্যোগ নিয়েছিলাম খতিয়ে দেখতে আসলে ব্যাপারটা কি। কারণ সত্যি সত্যি যদি রোহিঙ্গাদের মধ্যে হেপাটাইটিস সি’র প্রাদুর্ভাব খুব বেশি হয় তাহলেতো নিরাপদ নয় আমার দেশের মানুষগুলোও। এটা ঠিক যে এ রোগ ছড়ায় রক্তের মাধ্যমে। কিন্তু তারপরও হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের দূষিত সুইয়ের খোঁচা কিংবা সেভিং ক্ষুরের ছোট্ট কাটাটাওতো নিরাপদ নয়। পাশাপশি তো থাকছেই অনিরাপদ শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে রোগ ছড়ানোর বিষয়টিও। শুধু মাথায় ঢুকছিলো না ব্যাপারটা কি আসলেই সেরকম ভয়াবহ কিনা, যেমনটা আমরা ভাবছি। কারণ ইন্টারন্যাশনাল জার্নালগুলো ঘেটেঘুটে দেখলাম মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের মধ্যে হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবটা আমাদের মতই, অর্থাৎ এক শতাংশেরও কম। কিন্তু সহকর্মীদের পর্যবেক্ষণতো উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। হাজার হোক তারাইতো মাঠে আছেন, মাঠে থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি যেসব দেশীয় কোম্পানী সি ভাইরাসের ওষুধ বানান আর বিপণন করেন, তাদের সাথে কথা বলেও একইরকম তথ্য পাচ্ছিলাম।

কাজেই আমাদের ফোরাম ফর দ্য স্টাডি অব দ্য লিভার বাংলাদেশ’র পক্ষ থেকে একটা উদ্যোগ নিয়ে ফেললাম। একেতো ভেতরের তাগিদ, তার ওপর আরো একবার কক্সবাজার যাওয়ার সুযোগ! তবে কাজটা করতে নেমে দেখলাম যতটা সহজ ভেবেছিলাম, বিষয়টা আদতে অতটা সহজ হতে যাচ্ছে না। চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক। সরকারি অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। ছিল প্রয়োজন অর্থেরও। প্রয়োজন যেমন ছিল টেকনিশিয়ানদের, তেমনি রোহিঙ্গাদের সাথে তাদের ভাষায় কথা বলতে পারা ভলান্টিয়ারও প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের একসাথে জড়ো করে, পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে তাদের আস্থায় নিয়ে, নির্বিঘ্নে কাজটা শেষ করার ব্যাপারটাও ছিল। যেমন ছিল সকাল সকাল কুতুপালং আর বালুখালিতে পৌঁছে, মোটামুটি সব আয়োজন গুছিয়ে, রক্তের স্যাম্পলগুলো নিয়ে দিনের আলো থাকতে থাকতেই কক্সবাজারে ফিরে আসার ব্যাপারটাও। এখন যখন পেছনে ফিরে তাকাই, অবাক হয়ে ভাবি না বুঝেই ‘নাপিত ডাক্তারের’ মতোই কি বড় কাজেই না নেমে পড়েছিলাম। আবার পাশাপাশি ভাবতেই বুকটা ভরে যায় যে কত লোকের নিঃশর্ত, নিঃস্বার্থ সমর্থনইতো পেয়েছি। সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন যেমন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, তেমনি এগিয়ে এসেছেন বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের মত বেসরকারি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানও। ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের মেডিসিন ক্লাবের ভলানটিয়াররা। অকুন্ঠ সমর্থন দিয়েছেন কক্সবাজার প্রশাসন, স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা আর ইসলামিক ফাউন্ডেশনও। সাথে সাত সাগরের অপর পারে জাপানে বসে আমার রিসার্চগুরু আর ‘ন্যাসভ্যাকের’ সহগবেষক ডাক্তার আকবর ভাইয়ের সমর্থনের কথা না বললে অন্যায় হবে বড় ধরনের। একটি ভাল মাপের বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পূর্ণ করায় তিনি যে শুধু মেধা দিয়েই আমাদের পাশে ছিলেন তাই নয়, বরং তার কারণেই আমরা পাশে পেয়েছি জাপান হেপাটাইটিস রিসার্চ ফাউন্ডেশন আর জাপানের এহিমে বিশ্ববিদ্যালয়কে। সমস্ত রক্তের স্যাম্পলগুলো তাই আমরা পরীক্ষা করিয়ে আনতে পেরেছি পৃথিবীর প্রথম সারির ল্যাবরেটরি থেকে আর আমাদের ডাটাগুলোও তাই অনায়াসে প্রকাশিত হয়েছে ইউরো-এশিয়ান জার্নাল অব হেপাটোগ্যাস্ট্রোএন্টারোলজির মত প্রথম সারির আন্তর্জাতিক, ইনডেক্সড, বৈজ্ঞানিক জার্নালে।

মানবতাবাদী একটি রাষ্ট্রের একজন লিভার বিশেষজ্ঞের প্রশ্ন
কক্সবাজারের টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ছবিঃ খবর৭১।

কিন্তু ডাটা যখন চোখের সামনে, চোখতো তখন কপালে! চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি কুতুপালং আর বালুখালিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের তের শতাংশের বেশি হেপাটাইটিস সি’তে আক্রান্ত। আমার দেশের কোটি মানুষের ভিড়ে হেপাটাইটিস সি খুঁজে পাওয়া যাবে বড়জোর আট লাখের মত। অথচ উখিয়া-টেকনাফেই আছে প্রায় তিন লক্ষ হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত রোহিঙ্গা। মানুষ হিসেবে তাদের প্রয়োজন চিকিৎসার আর আমার প্রয়োজন পাশাপাশি আমার মানুষগুলোরও লিভারের নিরাপত্তা।

বাংলাদেশ আজ জেনেরিক ওষুধের মুকুটহীন সম্রাট। আমরা পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র যারা নিজেদের মোট ওষুধের চাহিদার ৯৫ ভাগেরও বেশি নিজেরাই তৈরি করি। আর পাশাপাশি সেগুলো রপ্তানিও করি পৃথিবীর একশটিরও বেশি দেশে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে সি ভাইরাসের ওষুধের দাম কোটি টাকা প্রায়, আমার দেশে তা পানির দর। তারপরও তো এদেশে এক কোর্স হেপাটাইটিস সি’র ওষুধ কিনতে ফুরায় প্রায় লক্ষ টাকা। এই তিন লক্ষ টাকার জোগান দেবে কে? রোহিঙ্গা সমস্যাটিতো আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া। আমাদের নেত্রী মানবিকতার পরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে তাদের আপন করে নিয়েছেন। এখনও পেলে-পুষে চলেছেন। কিন্তু আর কতদিন? যেসব বিদেশী আর তাদের দেশীয় সহযোগীরা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে থেকে যেতে উৎসাহিত করেছেন, বৈজ্ঞানিক একটি বিষয়বস্তুর উপর এই অবৈজ্ঞানিক লেখাটি তাদের উদ্দেশ্য করেই। আপনারা যারা নিজ বাসভূমে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, আমার মানুষ কেন অনিরাপদ? আমার দেশের স্বাস্থ্য আর অর্থনীতির উপর এই যে বাড়তি বোঝা, এর ভার আপনারা কত তাড়াতাড়ি নেবেন? একজন বাংলাদেশী লিভার বিশেষজ্ঞ আর পাশাপাশি মানবতাবাদী একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আপনাদের কাছে এটা বোধকরি খুব বেশি কোনো চাওয়া নয়?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here