খবর৭১ঃ যুবলীগের চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া ওমর ফারুক চৌধুরীসহ সিনিয়র এক ডজনেরও বেশি নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। সংস্থাটির জালে থাকা নেতাদের অবৈধ সম্পদ ও পাচার হওয়া অর্থের বিষয়ে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
এরই মধ্যে গ্রেফতার দুই যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলাও করেছে দুদক। সম্পদের হিসাব চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে অনেককে। ওমর ফারুকসহ যুবলীগের ৭ নেতার পরিবার ও তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে। এদের অধিকাংশই ক্যাসিনো, দখল ও টেন্ডার দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন। বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন। তাদের পাচার করা অবৈধ অর্থ এবং সম্পদের খোঁজে দুদকের টিম ৫ দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
জানা গেছে, দুদকের প্রাথমিক তালিকাভুক্ত নামের সংখ্যা ৪৩ থেকে বেড়ে ৬১ হয়েছে। এর আগে দুদক সচিব বলেছিলেন তাদের প্রাথমিক তালিকায় ৪৩ জনের নাম আছে। তালিকায় আছেন রাজনৈতিক দলের নেতা, সামাজিক সংগঠনের সদস্য, ব্যবসায়ীসহ সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তা।
দুদক এদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান শুরু করেছে, নানা দিক থেকে খোঁজখবর নিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে এনবিআর, ভূমি অফিস, সাবরেজিস্ট্রি অফিস, রিহ্যাবসহ বিভিন্ন সরকারি দফতরে চিঠি দিয়ে সংশ্লিষ্টদের অর্থ সম্পদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তালিকাভুক্তদের মধ্যে কমপক্ষে এক ডজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতিও চূড়ান্ত করেছে দুদক।
সোমবার ওমর ফারুক চৌধুরী, তার স্ত্রী, তিন ছেলে ও তাদের দুই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ওমর ফারুক চৌধুরীর ব্যাংক হিসাব তলব করেছিল। শেখ ফজলুর রহমান মারুফ, তার স্ত্রী সানজিদা রহমান, তাদের দুই ব্যবসায়িক ব্যাংক হিসাবে লেনদেন ও স্থানান্তর করতে পারবেন না বলে সোমবার জানিয়ে দিয়েছে এনবিআর।
এছাড়া একই দিন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাউসার, স্ত্রী পারভীন লুনা, মেয়ে নুজহাত নাদিয়া নিলা এবং তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, কে এম মাসুদুর রহমান, তার স্ত্রী লুতফুর নাহার লুনা, বাবা আবুল খায়ের খান, মা রাজিয়া খান এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, যুবলীগের দফতর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, তার স্ত্রী সুমি রহমান ও তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান, তারেকুজ্জামান রাজিব ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ১১৬ ধারার ক্ষমতাবলে ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিতের আদেশ দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, অনুসন্ধান শুরুর ১০ দিনের মাথায় সোমবার যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও ব্যবসায়ী জি কে শামীম, তার স্ত্রী আয়েশা আক্তার এবং যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের মামলা করেছে দুদক।
মামলায় জি কে শামীম ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ১৯৭ কোটি ৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকার আয়বহির্ভূত ও অবৈধ সম্পদের অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া খালেদের বিরুদ্ধে ৫ কোটি ৫৮ লাখ ১৫ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা হয়েছে।
উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম ও মো. সালাহউদ্দিন বাদী হয়ে দুদকের ঢাকা জেলা সমন্বিত কার্যালয়ে মামলা দুটি দায়ের করেন। পরে জি কে শামীম ও খালেদকে এ মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানোর জন্য আদালতে আবেদন করেন দুদকের কর্মকর্তারা। এ দুই আসামি র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়ে এখন জেলে আছেন। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি দখল ও টেন্ডার দুর্নীতিতে জড়িতদের আরও এক ডজন নেতার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা প্রস্তুত হচ্ছে।
এ সপ্তাহেই একাধিক মামলা হতে পারে। সংসদ সদস্য নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন ও তার স্ত্রী ফারজানা চৌধুরী, চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরীর সম্পদেরও অনুসন্ধান করেছে দুদক টিম। অন্যদিকে যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের অবৈধ অর্থ সম্পদের অনুসন্ধান করতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে দুদক।
সংশ্লিষ্ট এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেশে সম্রাটের এক থেকে দেড় কোটি টাকার বেশি সম্পদের তথ্য মিলছে না। তার বিরুদ্ধে এ পরিমাণ টাকার অবৈধ সম্পদের মামলা হলে তা হাস্যকর হতে পারে। ক্যাসিনো ব্যবসা, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজিসহ নানা উপায়ে তিনি যে সম্পদ করেছেন তার প্রায় সবই বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন বলে ওই কর্মকর্তা মনে করছেন।
তাই সম্রাটসহ যেসব নেতা অর্থ পাচার করেছেন সেই সম্পদের খোঁজে দুদকের টিম বিদেশে যেতে পারে বলে আভাস দেন তিনি। এদিকে গণপূর্ত অধিদফতরের বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজে কমিশন নিয়ে জি কে শামীমের পক্ষ হয়ে কাজ করেছেন ওই বিভাগের এমন পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। তাদের মধ্যে সদ্য সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী রাশেদা ইসলাম, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাই ও তার স্ত্রী বনানী সুলতানার সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ দিয়েছে দুদক।
সোমবার দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের স্বাক্ষরে তাদের আবাসিক ঠিকানায় চিঠি পাঠানো হয়। এতে আগামী ২১ কার্যদিবসের মধ্যে সম্পদের বিবরণী দাখিল করতে বলা হয়েছে। জানা গেছে, দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে রফিকুল ইসলামের ১ কোটি টাকার কিছু বেশি ও আবদুল হাইয়ের দেড় কোটি টাকার সম্পদের তথ্য মিলেছে। তবে তাদের এত অল্প সম্পদ আছে দুদক তা মনে করছে না সে কারণে তাদের হিসাব তলব করা হয়েছে। বিবরণী পাওয়ার পর অন্যান্য মাধ্যম থেকে বাকি তথ্য সংগ্রহ করা হবে। তারা দেশের বাইরে অর্থ পাচার করেছেন- এমন তথ্যও রয়েছে দুদকের কাছে।
জি কে শামীম ও খালেদের বিরুদ্ধে মামলাঃ অবৈধ উপায়ে জ্ঞাতআয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ২৯৭ কোটি ৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকার সম্পদ অর্জন ও দখলে রেখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করায় স্ত্রীসহ জি কে শামীমের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। অন্যদিকে খালেদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে ৫ কোটি ৫৮ লাখ ১৫ হাজার ৮৫৯ টাকার অবৈধ সম্পদ থাকার অভিযোগ আনা হয়। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির ঘটনায় অনুসন্ধান শুরুর পর এ দুটি মামলাই প্রথম করল দুদক।
জি কে শামীমের মামলায় বলা হয়, তিনি ২০১৮-১৯ করবর্ষ পর্যন্ত ৫০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। এর মধ্যে ৪০ কোটি ২১ লাখ ৪০ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদের তথ্য আয়কর নথিতে দিয়েছেন। বাকি ৯ কোটি ৭৮ লাখ ৫৯ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য আয়কর নথিতে দেননি। তার ৫০ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। একই করবর্ষে তার স্ত্রী ৩৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য দেন।
কিন্তু এর মধ্যে ৩৬ কোটি ৩৫ লাখ ১৮ হাজার টাকার সম্পদের কোনো বৈধ উৎস দেখাতে পারেননি। জি কে শামীমের মায়ের নামে ৪৩ কোটি ৫৭ লাখ ৪০ হাজার টাকার কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। এছাড়া গ্রেফতারের পর জি কে শামীমের অফিস থেকে ১ কোটি ৮১ লাখ ২৮ হাজার টাকা, ৯ হাজার মার্কিন ডলার জব্দ করা হয়। তার ১৬৫ কোটি ২৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকার যে এফডিআর রয়েছে তারও কোনো বৈধ উৎস খুঁজে পায়নি দুদক।
অপরদিকে খালেদের নামে ২০১৮-১৯ করবর্ষে ১ কোটি ৬৬ লাখ ১০ হাজার ৮০০ টাকার স্থাবর সম্পদ দেখানো হয়। কিন্তু পারিপার্শ্বিক ও রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দুদক জানতে পারে তার আরও বেশি সম্পদ আছে। তিনি ২ কোটি ৮৩ লাখ টাকার সম্পদ তার আয়কর নথিতে দেখাননি। এছাড়া তার ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকার স্থাবর সম্পদের কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার ৫ কোটি ৫৮ লাখ ১৫ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য মেলে।
জি কে শামীম ও খালেদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান পর্যায়েই মামলা হয়। একইভাবে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের আরও ডজনখানেক নেতার বিরুদ্ধে মামলা তৈরি হচ্ছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। বিশেষ করে যারা গ্রেফতার হয়েছেন, তাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধে মামলার এজাহার তৈরি হচ্ছে। তবে সরকারি যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তাদের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ জারি করা হচ্ছে।
তাদের ক্ষেত্রে নোটিশ জারি প্রসঙ্গে দুদকের একজন পরিচালক বলেন, সরকারি চাকরি করায় তাদের সেলারি, বিভিন্ন ফান্ড ও ভাতাদির টাকা বৈধ উপায়ে অর্জিত হয়। সেই বৈধ অর্থ বাদ দিয়ে অবৈধ উপায়ে যে অর্থ তারা অর্জন করেছেন সেটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য হিসাব চেয়ে থাকি। এটি সবার ক্ষেত্রে আবার নাও হতে পারে। অনুসন্ধান চলাকালীন যদি কারও বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের তথ্য আমাদের হাতে আসে আমরা সরাসরিও মামলা করতে পারি।
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সোমবার বলেন, ডকুমেন্ট পেলে আমরা সরাসরি মামলা করতে পারি। আমাদের নজরে যদি ‘কগনিজেবল অফেন্স’ আসে, আমরা যদি বিশ্বাস করি এটি অফেন্স (অপরাধ-দুর্নীতি) আমরা সরাসরি মামলা করতে পারি।
সোমবার যে দুটি মামলা হয়েছে, এ দু’জনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক কিছু অনুসন্ধান হয়েছে। তারপর মামলা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা গণমাধ্যম থেকে অনেক তথ্য পাই।এরপর অনুসন্ধান করি। অনুসন্ধানকালে যদি আমরা বুঝতে পারি অপরাধী তার অবৈধ সম্পদ সরিয়ে ফেলতে পারে বা স্থানান্তর করতে পারে সেক্ষেত্রে সরাসরি সম্পদের মামলা করতে পারি।
১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার ক্লাবপাড়ায় অভিযান শুরুর প্রথমদিনেই গুলশানের বাসা থেকে খালেদকে গ্রেফতার করে র্যাব। জি কে শামীমকে গ্রেফতার করা হয় ২০ সেপ্টেম্বর গুলশানের নিকেতনের তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে। দু’জনের বিরুদ্ধে তখন একাধিক মামলা দেয়া হয়