খবর৭১ঃ ক্যাসিনো থেকে প্রতি মাসে নিয়মিত মাসোহারা না পেলে অকথ্য ভাষায় যুবলীগের নেতাদের গালিগালাজ করতেন সাবেক মন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের। জুয়ার টাকায় তিনি ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণসহ বিলাসী জীবনযাপন শুরু করেন বর্ষীয়ান এই বামপন্থী নেতা।
ইয়ংমেনস ক্লাব থেকে র্যাবের উদ্ধার করা চাঁদাবাজির খাতায় মেননের নাম রয়েছে ৫নং সিরিয়ালে।প্রতি মাসে সম্রাটের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা নিতেন তিনি। র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ওরফে ক্যাসিনো সম্রাট এসব তথ্য দিয়েছেন।
এছাড়া রাজনৈতিক নেতা নামধারী অনেকেই সম্রাটের দফতরে হাজির হতেন জুয়ার টাকার ভাগ নিতে। প্রতি মাসে ব্যাগভর্তি করে জুয়ার টাকা নিয়ে তারা বেরিয়ে যেতেন। সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজেও এর প্রমাণ রয়েছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বিভিন্ন নেতা ছাড়াও টাকার ভাগ পেতেন পল্টন, মতিঝিল ও ফকিরাপুল এলাকার প্রভাবশালীরা।
সূত্র জানায়, রাশেদ খান মেননের শেল্টারেই ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনো গড়ে ওঠে। ইয়ংম্যানস ক্লাবের ক্যাসিনো পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আরেক বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমদু ভূঁইয়া। জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট জানিয়েছেন, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসী থেকে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে যুবলীগের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেন রাশেদ খান মেনন। খালেদকে আরও বড় পদ-পদবি দেয়ার জন্য তিনি বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলে তদবির করেন।
মেননের আশ্রয় পেয়ে রাজধানীর বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন খালেদ। রাজধানীর অন্যতম বৃহৎ প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজে খালেদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কলেজে নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে উন্নয়ন কাজ ও শিক্ষার্থী ভর্তিতে বিপুল অংকের টাকা লেনদেন হয়। খালেদের মাধ্যমে এই টাকার একটি বড় অংশ চলে যেত রাশেদ খান মেননের পকেটে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি থাকাকালেও মেননের বিরুদ্ধে ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। নামকরা দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন ও আইডিয়াল কলেজে ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন রাশেদ খান মেনন ও তার সহযোগীরা।
মেননের বিরুদ্ধে অনেক অভিভাবক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগও জমা দেন। কিন্তু শেষমেশ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এছাড়া আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি বাণিজ্য নিয়ে সাংবাদিকরা অনুসন্ধান করে তার বিরুদ্ধে ভয়াবহ নিয়োগ বাণিজ্যের প্রমাণ পায়। কিন্তু তার হাইভোল্টেজ তদবিরের কারণে ওই সময় এসব রিপোর্ট কেউ ছাপতে পারেনি।
২৮ সেপ্টেম্বর ইয়ংম্যানস ক্লাবে অভিযান চালানোর সময় ক্যাসিনো থেকে আর্থিক সুবিধাভোগীদের নামের একটি লম্বা লিস্ট উদ্ধার করে র্যাব। এ তালিকার ৫ নম্বরে নাম আছে রাশেদ খান মেননের। তার নামের পাশে লেখা আছে ১০ লাখ। অর্থাৎ ক্যাসিনো থেকে মাসে রাশেদ খান মেনন ১০ লাখ টাকা পেতেন।
অবশ্য ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন রাশেদ খান মেনন এমপি। তিনি বারবারই গণমাধ্যমে বলছেন, ক্লাব পরিচালনার সঙ্গে জড়িত থাকলেও ক্যাসিনোর সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট জানান, গত সংসদ নির্বাচনের আগে রাশেদ খান মেনন এককালীন কয়েক কোটি টাকা নেন। পার্টি ফান্ডে নির্বাচনী ডোনেশন হিসেবে এই টাকা নেন তিনি।
এছাড়া পোস্টার ছাপানো থেকে শুরু করে নির্বাচনী ক্যাম্প বানানো ও মাইকে প্রচারের সবকিছুই আয়োজন করে দেন সম্রাট। খালেদের মাধ্যমে এসব নির্বাচনী আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কিত খরচের বিল দেয়া হতো।
সম্রাট আরও বলেন, তিনি নিজেও ঢাকা-৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রাশেদ খান মেনন তাকে নির্বাচনে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। সম্রাটকে বিশেষ স্নেহ করতেন রাশেদ খান মেনন।
রাজনৈতিক মহলে সম্রাটের অকুণ্ঠ প্রশংসা করতেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে প্রকাশ্যেই বলতেন ‘সম্রাটের হৃদয় আকাশের মতো উদার। সে একদিন অনেক বড় নেতা হবে’।
সূত্র জানায়, রিমান্ড জিজ্ঞাসাবাদে বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদও তথ্য প্রমাণ দিয়ে মেননের চাঁদাবাজির ফিরিস্তি তুলে ধরে।
খালেদ জানান, মেনন ভাইকে বিভিন্ন টেন্ডার থেকেও টাকা পয়সা দিতে হত। বড় বড় অনেক ঠিকাদারি কাজের টেন্ডার পাওয়ার পর ৫ পার্সেন্ট হারেও কমিশন নিয়েছেন মেনন। জিকে শামীমের সঙ্গে তার বিশেষ সখ্যতা গড়ে ওঠে।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেননের নাম উঠে আসা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম যুগান্তরকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। এসব তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। ক্যাসিনোর সঙ্গে যারাই জড়িত ছিলেন তাদের সবাইকেই আইনের মুখোমুখি করা হবে। সেক্ষেত্রে কে বাম নেতা বা কে ডানপন্থী নেতা তা আমাদের বিবেচ্য নয়।
রাশেদ খান মেনন ছাড়াও যুবলীগের আরও বেশ কয়েকজন নেতার নাম বলেছেন সম্রাট। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কাওসার। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর পরই মোল্লা কাওসার দেশ ছাড়েন। প্রথম তিনি ভারতে আত্মগোপন করেন। পরে ভারত হয়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। মোল্লা কাওসার বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন সিটিতে মেয়ের বাসায় থাকছেন বলে জানিয়েছে সূত্র। এছাড়া ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে জড়িত আরও বেশ কয়েকজন বড় মাপের রাজনীতিক দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে।
রাজধানীর বনানীতে বসে আন্ডারওয়ার্ল্ডের অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন এমন একজন হেভিওয়েট রাজনীতিক হঠাৎ করেই চুপচাপ হয়ে গেছেন। র্যাবের অভিযান শুরুর পর তিনি অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।