খবর৭১ঃ দেশব্যাপী চলছে ‘শুদ্ধি অভিযান’। গতকাল এ অভিযানের একমাস পূর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন যুবলীগ নেতা (বহিষ্কৃত) ইসমাইল হোসেন সম্রাটসহ মোট ১৮ জন। কিন্তু যাদের নাম এসেছে তাদের অনেকেই রয়েছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বিভিন্ন দফায় রিমান্ড শেষে ১৬ জন কারাগারে রয়েছেন। র্যাব হেফাজতে রিমান্ডে জিজ্ঞাসবাদ চলছে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও আরমানের। নগদ সাড়ে আট কোটি টাকাসহ জব্দ করা হয়েছে প্রায় ১৬৬ কোটি টাকার এফডিআর। গ্রেফতার হয়েছেন—ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, যুবলীগ নেতা ঠিকাদা জি কে শামীম, কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি ও কৃষকলীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ, মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ‘অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা’ সেলিম প্রধান, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, যুবলীগ নেতা এনামুল হক আরমান, জি কে শামীমের সাত দেহরক্ষী-দেলোয়ার হোসেন, মুরাদ হোসেন, জাহিদুল ইসলাম, সহিদুল ইসলাম, কামাল হোসেন, সামসাদ হোসেন ও আমিনুল ইসলাম, সেলিম প্রধানের দুই সহযোগী আক্তারুজ্জামান ও রহমানসহ ১৮ জন।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিভিন্ন খাতে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলতা এবং অবৈধ অর্থের বিরুদ্ধে গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে এ শুদ্ধি অভিযান শুরু করে সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থা। তবে এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এ বিশেষ অভিযানে সরাসরি দায়িত্ব পালন করছে।
অভিযানের প্রাপ্ত ফলাফল
প্রাপ্ত তথ্য অনুয়ায়ী, গত ১৮ সেপ্টম্বর অভিযান শুরু হয়। এসময় ক্লাব, বাসাবাড়ি ও অফিসসহ মোট ১৯টি স্থানে অভিযান চালানো হয়। যার মধ্যে ১১টি ক্লাবে ক্যাসিনোর অভিযোগে অভিযান পরিচালনা করে র্যাব। এর মধ্যে রাজধানীতে ৮টি এবং ৩টি চট্টগ্রামে। উদ্ধার করা বিভিন্ন ধরনের ক্যাসিনো সামগ্রী। যার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। ক্লাবগুলোর মধ্যে রয়েছে-রাজধানীর ফকিরাপুল ইয়ং মেনস ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা চিত্তবিনোদন ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ, কলাবাগান ক্রীড়া চক্র, ধানমন্ডি ক্লাব, ফু-ওয়াং ক্লাব এবং চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, আবাহনী ক্লাব ও মোহামেডান ক্লাব। গ্রেফতার করা হয় বহুল আলোচিত ইসমাইল হোসেন সম্রাটসহ ১৮ জনকে। এছাড়া অভিযানের সময় বিভিন্ন ক্যাসিনোতে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ২০১ জনকে আর্থিক জরিমানাসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করেন।
অভিযান শুরু
১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ফকিরাপুলের ইয়ং মেনস ক্লাবের ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় র্যাব। ওইদিন রাতেই একে একে ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা চিত্তবিনোদন ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ ক্লাবে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ক্যাসিনোর সন্ধান পায় তারা। ওই রাতেই গুলশানের বাসা থেকে গ্রেফতার হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (পরে বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। ২০ সেপ্টেম্বর র্যাব গ্রেফতার করে যুবলীগ নেতা ঠিকাদার জি কে শামীমকে। এসময় তার অফিস থেকে উদ্ধার করা হয় নগদ ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ও ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর। একই দিন রাতে রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়াচক্র ও ধানমন্ডি ক্লাবে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি ও কৃষকলীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজকে। ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর মণিপুরীপাড়ার বাসায় অভিযান চালিয়ে মাদকসহ আটক করা হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ও মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকে। ৩০ সেপ্টেম্বর বিদেশে পালানোর সময় থাইল্যান্ডগামী একটি প্লেন থেকে আটক করা হয় ‘অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা’ সেলিম প্রধানকে। ৬ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি (পরে বহিষ্কৃত) ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও তার সহযোগী এনামুল হক আরমানকে। পরে তাকে নিয়ে অভিযান চালানো হয় কাকরাইলস্থ তার অফিস ও কয়েকটি বাসায়। সর্বশেষ ১১ অক্টোবর সিলেটর শ্রীমঙ্গল থেকে গ্রেফতার করা হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানকে।
মামলা দায়ের
গত একমাসের অভিযানে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় মোট ২৭টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার নামে গুলশান থানায় তিনটি (অস্ত্র, মাদক, মানি লন্ডারিং) ও মতিঝিল থানায় মাদক আইনে একটি মামলা করা হয়েছে। ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাবে মাদক উদ্ধারের ঘটনায় মাদক আইনে মতিঝিল থানায় একটি মামলা, জি কে শামীমের নামে গুলশান থানায় তিনটি (অস্ত্র, মাদক, মানি লন্ডারিং) মামলা, শফিকুল আলম ফিরোজের নামে ধানমন্ডি থানায় অস্ত্র আইনে একটি ও গুলশান থানায় মাদক আইনে একটি মামলা, এনামুল হক ও তার ভাই রুপণ ভূঁইয়াসহ সহযোগীদের নামে গেন্ডারিয়া থানায় মানি লন্ডারিং আইনে একটি, সূত্রাপুর থানায় মানি লন্ডারিং আইনে দুটি, বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুটি, ওয়ারী থানায় মানি লন্ডারিং আইনে একটি ও অস্ত্র আইনে একটি মামলা করা হয়েছে। ফু-ওয়াং ক্লাবে মাদক উদ্ধারের ঘটনায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইন ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা, মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ ও বিসিবি পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার নামে তেজগাঁও থানায় মাদক আইনে একটি মামলা, অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী সেলিম প্রধানসহ তিন জনের নামে গুলশান থানায় মাদক ও মানি লন্ডারিং আইনে দুটি মামলা, ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের নামে রমনা মডেল থানায় অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা এবং কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানায় এনামুল হক আরমানের নামে মাদক আইনে একটি মামলা, হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানের নামে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থানায় অস্ত্র আইনে একটি ও রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার দুটি, জি কে শামীমের দুটি, শফিকুল আলম ফিরোজের দুটি, ফুয়াং ক্লাবের দুটি, সেলিম প্রধানের একটি ও সম্রাটের দুটি মামলাসহ ১১টি মামলা তদন্ত করছে র্যাব।
জব্দ করা হয়েছে
র্যাব এ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি মুদ্রাসহ প্রায় ৮ কোটি ৪৫ লাখ নগদ অর্থ জব্দ করেছে। উদ্ধার করা হয়েছে ১৬৬ কোটি ২৭ লাখ টাকার এফডিআর, ১৩২টি বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই ও ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক। ৭ দশমিক ২০ ভরি অলংকার (৮ কেজি) জব্দ করা হয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা। জব্দ করা হয়েছে অবৈধ বা বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের অভিযোগে ২৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। পাশাপাশি উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ও বিদেশি মদ। যুবলীগ নেতা ঠিকাদার জি কে শামীমের অফিসে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ টাকা-মদ।