বঙ্গবন্ধু প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ঃ নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে তৃতীয় শ্রেণি পাওয়া ব্যক্তিরাও গুরুত্বপূর্ণ পদে

0
491
নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে তৃতীয় শ্রেণি পাওয়া ব্যক্তিরাও গুরুত্বপূর্ণ পদে

খবর৭১ঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগবিধি অনুযায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে শিক্ষাগত যোগ্যতায় তৃতীয় বিভাগ গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা বিকম (সম্মান) তৃতীয় শ্রেণি। একজন উপরেজিস্ট্রারের স্নাতক ও এসএসসি—দুটিতেই তৃতীয় শ্রেণি।

কয়েকজন শিক্ষক অভিযোগ করেছেন, শুধু এই দুটি পদেই নয়, এমন আরও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে। বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগেও অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে।

উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন জোরালো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মেয়াদে হওয়া বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগও বাড়ছে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাঁদের অবস্থান একটাই, বর্তমান উপাচার্যের পদত্যাগ বা বিদায়। উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা এক সপ্তাহ ধরে দিনে-রাতে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। গতকাল বুধবার তাঁরা অনশনের পাশাপাশি ঝাড়ুমিছিল করেছেন।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্ত দল গতকাল ক্যাম্পাসে এসেছে। কমিটির প্রধান ও ইউজিসির সদস্য মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, তাঁরা সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন। কমিটির সদস্যরা গতকালই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে আরেকজন সহকারী প্রক্টর পদত্যাগ করেছেন। এর আগে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সহকারী প্রক্টর হুমায়ুন কবির পদত্যাগ করেছিলেন।

নিয়োগ নিয়ে যত কাণ্ডঃ

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়া নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগের অধিকাংশই হয়েছে বর্তমান উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের মেয়াদে। ২০১৫ সাল থেকে তিনি উপাচার্যের দায়িত্ব (এখন দ্বিতীয় মেয়াদ) পালন করছেন। অবশ্য উপাচার্য গত মঙ্গলবার বলেছেন, নিয়োগ নিয়ম মেনেই হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষক বলেন, অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি থাকার পরও নানা কৌশলে কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়কে এর জের টানতে হবে বহু বছর।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, তৃতীয় শ্রেণি পাস করা পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগবিধি অনুযায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে শিক্ষাগত যোগ্যতায় তৃতীয় বিভাগ বা জিপিএ-২ দশমিক ৫০-এর নিচে গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু পাশেই বন্ধনীর মধ্যে বলা হয়েছে, অধিকতর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করা যেতে পারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এস এম গোলাম হায়দার কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেছেন, যার মধ্যে বিকমে (সম্মান) তৃতীয় শ্রেণি পেয়েছিলেন। অথচ তিনি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেয়েছেন। অবশ্য তিনি বলেছেন, নিয়োগবিধির শর্ত মেনেই আবেদন করেছেন। নিয়ম মেনে নিয়োগ পেয়েছেন।

উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মেকাইল ইসলামের শিক্ষাজীবনেও তৃতীয় শ্রেণি (এইচএসসি) রয়েছে। তিনি বেসরকারি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। উপ-রেজিস্ট্রার খান মোহাম্মদ আলী এসএসসি ও স্নাতকে তৃতীয় শ্রেণি পেয়ে পাস করেছেন। আর এইচএসসিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাস। তিনিও এশিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি (প্রথম শ্রেণি) নিয়েছেন। উপাচার্যের দপ্তরের একজন কর্মকর্তারও শিক্ষাজীবনের একটিতে (এইচএসসি) তৃতীয় শ্রেণি রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের কয়েকজন আত্মীয়কেও বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন।

নিয়োগবিধিতে শিক্ষাগত যোগ্যতায় তৃতীয় শ্রেণি পাস ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া যায় কি না, জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. নূরউদ্দিন আহমেদ বলেন, মনে হয় তৃতীয় শ্রেণি গ্রহণযোগ্য নয়। তবে নিয়োগ সম্পর্কে তিনি বলতে পারবেন না, সেটা বলবে নিয়োগ বোর্ড।

কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক মো. আক্কাছ আলীর নিয়োগ ও পরবর্তী কিছু বিষয়ও আলোচনায় আছে। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক (সম্মান) পাস করেছেন। স্নাতকের ফলও ভালো। কিন্তু বুয়েটে স্নাতকোত্তর পড়ার সময়ই তাঁর পরীক্ষার ফল সিজিপিএ–৩ দশমিক ৭৬ দেখানো হয়। আবার পরে ক্রেডিট স্থানান্তর করে তিনি যেখানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি যখন স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন, তখন নতুন বিভাগটির শিক্ষার্থীদের স্নাতকোত্তরে ওঠার সময়ই হয়নি। এই শিক্ষককে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে আজীবনের জন্য অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

পড়ার খরচ বেশিঃ

কয়েকটি বিভাগের অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সরকারি হলেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়ার খরচ অনেক বেশি। আগে খরচ কম থাকলেও বর্তমান প্রশাসনের সময় সেটা বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ প্রথম বর্ষে ভর্তি হতে ১৯ হাজার টাকা লেগেছে। এরপর দ্বিতীয় শ্রেণিতে ওঠার পর বিভাগ ভেদে প্রতি সেমিস্টার (ছয় মাসের) শুরুর সময় আবারও ভর্তি খরচ ৪ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা। এর বাইরে আবার সেমিস্টার পরীক্ষা, কেন্দ্র ও প্রবেশপত্র বাবদ বিভাগ ভেদে আরও দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা দিতে হয়। ইলেকট্রনিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া একজন ছাত্র জানান, তিনি প্রথম বর্ষে সাত হাজার টাকার মধ্যে ভর্তি হয়েছিলেন। এখন ভর্তি ও পরবর্তী অন্যান্য ফি বাড়ানো হয়েছে। তাঁর হলে থাকার জন্য মাসে সাড়ে ৩০০ টাকা দিতে হয়।

অবশ্য শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভর্তি ফি ১৪ হাজার টাকা, সেমিস্টার ফি ২ হাজার টাকা এবং হলে থাকার ফি ১৫০ টাকা করার ঘোষণা দিয়েছে।

আন্দোলনকারী অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী আলাদাভাবে বলেন, বর্তমান উপাচার্যের প্রতি তাঁদের আর কোনো আস্থা নেই। এখন তাঁর বিদায়ই তাঁদের একমাত্র চাওয়া।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here