খবর৭১ঃ
বরগুনায় আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলা তদন্তে পুলিশের দৃষ্টি এখন রিফাতের স্ত্রী ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আয়শা সিদ্দিকার দিকে। তাঁকেই মামলার আসামি করে অভিযোগপত্র দিতে তড়িঘড়ি করছে পুলিশ। অথচ ঘটনার দেড় মাস পরও এই মামলার এজাহারভুক্ত চার আসামিকে গ্রেপ্তারে পুলিশের কোনো তৎপরতা নেই।
বরগুনা জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বরগুনা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হুমায়ুন কবির কয়েক দিন ধরে ঢাকায় অবস্থান করছেন। মামলার অভিযোগপত্রের ব্যাপারে উচ্চপর্যায়ের মতামত নিতে তাঁরা ঢাকায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
আয়শার বাবা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘আমি শুনছি, আমার মেয়েকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়ার জন্য পুলিশ জোর তৎপরতা শুরু করেছে। আমি সব সময় বলে আসছি, প্রভাবশালীকে বাঁচাতেই আমার নিরীহ মেয়েকে ফাঁসানো হচ্ছে। আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করার পর থেকে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছি। প্রাণের ভয়ে এখন ঢাকায় চলে এসেছি।’
বরগুনার একাধিক আইনজীবীও একই কথা বলছেন। তাঁরা বলেন, রিফাত শরীফ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ১২ জন। আর সন্দেহভাজন আসামি ৪ থেকে ৫ জন। প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড গত ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এ মামলায় নয়ন বন্ডের বাইরে এজাহারভুক্ত ৭ আসামি এবং আয়শাসহ সন্দেহভাজন ৮ আসামি মিলিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৫ জন। হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী ও নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকাকে প্রধান আসামি করা হলে হত্যার অভিযোগ প্রমাণের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাঁদের মতে, ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী আয়শাকে হত্যা-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর মামলার ভিত্তি দুর্বল হয়ে গেছে। এখন তড়িঘড়ি করে অভিযোগপত্র দিলে বিচারের ক্ষেত্রে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আইনজীবীদের মত হলো, মামলাটি খুবই স্পর্শকাতর। তাই সময় নিয়ে সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং আলামত বিচার-বিশ্লেষণ করে ধীরেসুস্থে অভিযোগপত্র তৈরি করা উচিত। তা ছাড়া ১০ সাক্ষীর মধ্যে আয়শা ছাড়া আর কোনো প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নেই। বাকি ৯ জনই মামলার বাদী আবদুল হালিম শরীফের আত্মীয় ও একই এলাকার বাসিন্দা। তাঁরা কেউই ঘটনা নিজের চোখে দেখেননি। তাই আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আয়শার আইনজীবী ও বরগুনা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল বারী আসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে মামলার তদারক কর্মকর্তা ও বরগুনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান বলেন, মামলার তদন্তে অগ্রগতি সন্তোষজনক। বাকি চার আসামিকে ধরতে অভিযান চলছে। অভিযোগপত্র কবে নাগাদ দেওয়া হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা তদন্ত কর্মকর্তা বলতে পারবেন। আয়শাকে এই মামলার কত নম্বর আসামি করা হবে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি এসপি স্যার জানেন’।
আয়শাকে আইনি সহায়তা দেওয়া প্রতিষ্ঠান আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির চেয়ারপারসন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না গতকাল বলেন, আলোচিত এই হত্যা মামলাটিকে শেষ করে দিতেই আয়শাকে পরিকল্পিতভাবে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ শুরু থেকেই বলে আসছিল এই হত্যার সঙ্গে জড়িতদের যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে, যারা এর পেছনে আছে, তাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে। কিন্তু তা করেনি। ঘটনার পেছনের শক্তিকে আড়াল করতেই এমনটা করা হয়েছে। গত ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে সন্ত্রাসীরা স্ত্রী আয়শার সামনেই প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে রিফাত শরীফকে। পরদিন রিফাতের বাবা আবদুল হালিম শরীফ বরগুনা থানায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। তাতে প্রধান সাক্ষী করা হয় রিফাতের স্ত্রী আয়শাকে। এই মামলায় এ পর্যন্ত পুলিশ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ১৫ জনের সবাই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড গত ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। মামলার দুই নম্বর আসামি রিফাত ফরাজীকে পুলিশ গ্রেপ্তার দেখায় ৩ জুন।
রিফাত শরীফ গ্রেপ্তার হওয়ার ১৮ দিনের মাথায় ১৩ জুলাই আয়শার শ্বশুর তাঁর ছেলে হত্যায় পুত্রবধূ জড়িত বলে সংবাদ সম্মেলন করেন। পরদিন আয়শাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে স্থানীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন আয়োজন করা হয়। মানববন্ধনে রিফাতের বাবা ছাড়াও বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক এবং সাংসদের ছেলে সুনাম দেবনাথ বক্তব্য দেন। ১৬ জুলাই আয়শাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর থেকে তিনি কারাগারে আছেন।
জামিন শুনানি কালঃ
আয়শা সিদ্দিকার জামিন চেয়ে করা আবেদনের ওপর গতকাল শুনানি হয়নি। কাল এই আবেদনের ওপর শুনানির জন্য দিন রেখেছেন হাইকোর্ট। গতকাল বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ শুনানির এ দিন রাখেন।
আয়শার জামিন চাওয়া হলে গত ২১ জুলাই বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত তা নাকচ করেন। এরপর ৩০ জুলাই বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আয়শার জামিন নামঞ্জুর হয়। এ অবস্থায় আয়শার জামিন চেয়ে ৪ আগস্ট আবেদনটি করা হয়।