খবর৭১ঃ
রাজধানীর অস্থায়ী কোরবানি পশুর হাটগুলো প্রায় প্রতি বছরই পানির দরে ইজারা দেয় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। আইনের মারপ্যাঁচ, প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার না হওয়া এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের খুশি রাখতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সংস্থা দুটি।
গত ৩ বছরে এসব হাট থেকে দুই সিটি ইজারা মূল্য পেয়েছে প্রায় ৫৭ কোটি টাকা। ইজারাদাররা ক্রেতাদের কাছ থেকে হাসিল বাবদ আদায় করেছেন প্রায় ২৩৬ কোটি টাকা। যা ইজারা মূল্যের চারগুণেরও বেশি। এবার দুই সিটি কর্পোরেশন ২৩টি হাটের ইজারামূল্য বাবদ রাজস্ব পেয়েছে ২২ কোটি ২৪ লাখ ২১ হাজার টাকা। দু-এক দিনের মধ্যেই জমে উঠবে হাটগুলো। এসব হাট থেকে ৮৬ কোটি ৩৮ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা হাসিল আদায় হতে পারে বলে বাজার বিশ্লেষকরা ভবিষ্যদ্বাণী করছেন।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা আরও সক্রিয় হলে পশুর হাট ইজারা থেকে অনেক বেশি রাজস্ব আদায় করা সম্ভব। এক্ষেত্রে টেন্ডার সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ করতে হবে হাট ইজারা। একই সঙ্গে হাসিল আদায়ের (শতকরা ৫ ভাগ) নীতিমালায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। তবে এক্ষেত্রে ভিন্ন মত রয়েছে দুই সিটি সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, সরকারি হাট-বাজারগুলোর ব্যবস্থাপনা, ইজারা পদ্ধতি এবং তা থেকে প্রাপ্ত আয় বণ্টন সম্পর্কিত নীতিমাল ২০১১ অনুযায়ী হাট ইজারা দেয়া হয়।
আর বিধিমালা অনুযায়ী, ৩ বছরের গড় মূল্যের ওপর মাত্র ৬ শতাংশ বৃদ্ধি করার বিধান রাখা হয়েছে। এ কারণে সিটি কর্পোরেশন চাইলেও ইচ্ছেমতো ইজারামূল্য বাড়াতে পারছে না। ফলে সরকার প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৬ সালে রাজধানীতে অস্থায়ী ভিত্তিতে ২২টি কোরবানির পশুর হাট বসানো হয়েছিল। ওই হাটগুলো থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। আর ইজারাদাররা হাসিল আদায় করে ৭৪ কোটি ৯০ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। ওইবার হাটগুলোতে গরু-ছাগল বিক্রি হয়েছিল ২ লাখ ৮৩ হাজার।
এর মধ্যে গরু বিক্রি হয়েছিল ২ লাখ ৪২ হাজার ৯৪৫টি। গরু থেকে ইজারাদাররা হাসিল আদায় করেন, ৭২ কোটি ৮৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। আর ছাগল বিক্রি হয়েছিল ৪০ হাজার ৪২০টি। ছাগল থেকে হাসিল আদায় হয়, ২ কোটি ২ লাখ ১০ হাজার টাকা। ওই বছর ব্যবসায়ীদের বাজার বিশ্লেষণে বেরিয়ে আসে গরুর গড়মূল্য ছিল ৬০ হাজার টাকা এবং ছাগলের গড়মূল্য ছিল ১০ হাজার টাকা। ইজারাদাররা পশুর দামের ওপর শতকরা ৫ টাকা করে হাসিল আদায় করেন। সেই হিসাবে গরু প্রতি হাসিল আদায় হয়েছে ৩ হাজার টাকা এবং ছাগল প্রতি হাসিল আদায় করেছেন ৫০০ টাকা।
২০১৬ সালে স্থানীয় সরকার বিভাগের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেয়া এক প্রতিবেদনে রাজধানীর পশু কোরবানির ব্যাপারে এমন সংখ্যা উপস্থাপন করা হয়। আর পশু ব্যবসায়ী এবং মাংস ব্যবসায়ীদের মতে, হাট কম-বেশি হলেও প্রতি বছর পশু বিক্রি প্রায় ৫ ভাগ বাড়ে। আর ২০১৬ থেকে অদ্যাবধি গরু-ছাগলের দামও প্রায় একই রকম রয়েছে। ২০১৭ সালে রাজধানীর পশু বিক্রি হয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৫৪১টি। এর মধ্যে গরু বিক্রি হয়েছে, ২ লাখ ৫৪ হাজার ১০০টি এবং ছাগল বিক্রি হয়েছে ৪২ হাজার ৪৪১টি।
গরু ও ছাগলের বিক্রি তুলনামূলকভাবে বাড়লেও একই গড়মূল্য ধরলে দেখা যায়, ওই বছরে গরু বিক্রি করে ইজারাদাররা হাসিল আদায় করেছেন ৭৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং ছাগল বিক্রি করে হাসিল আদায় করেছে ২ কোটি ১২ লাখ ২০ হাজার ৫০০ টাকা। রাজধানীর ২০টি পশুর হাট থেকে ৭৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকার হাসিল আদায় হলেও দুই সিটি রাজস্ব পেয়েছে মাত্র ১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। একইভাবে ২০১৮ সালে রাজধানীর কোরবানির হাটগুলোতে গরু-ছাগল বিক্রি হয়েছে ৩ লাখ ১১ হাজার ৪১৩টি। এর মধ্যে গরু বিক্রি হয়েছে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৮০৫টি এবং ছাগল বিক্রি হয়েছে ৪৪ হাজার ৫৬৩টি।
গরু বিক্রি করে ইজারাদার হাসিল আদায় করেছেন ৮০ কোটি ৪১ লাখ ৫০০ টাকা এবং ছাগল বিক্রি করে হাসিল আদায় করেছেন ২ কোটি ২২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। ওই বছর রাজধানীর ২৩টি পশুর হাট থেকে ইজারাদার ৮২ কোটি ৬৩ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকার হাসিল আদায় করলেও রাজস্ব আদায় হয়েছে ২১ কোটি ৯ লাখ টাকা।
চলতি বছর রাজধানীতে বসছে ২৩টি অস্থায়ী কোরবানি পশুর হাট। হাটগুলো থেকে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন রাজস্ব পাচ্ছে ২২ কোটি ২৪ লাখ ২১ হাজার টাকা। আর ইজারাদার হাসিল আদায় করবেন কমপক্ষে ৮৬ কোটি ৩৮ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা। এসব হাটে এবার প্রায় ৩ লাখ ২৬ হাজার ৯৩৬টি গরু-ছাগল বিক্রির সম্ভাবনা আছে। এর মধ্যে গরু প্রায় ২ লাখ ৮০ হাজার ১৪৫। এখান থেকে ইজারাদাররা ৮৪ কোটি ৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা হাসিল আদায় করতে পারবেন। আর ছাগল বিক্রি হবে ৪৬ হাজার ৭৯১টি। ছাগল বিক্রি থেকে করে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ টাকা হাসিল আদায় হতে পারে। ৩ বছরে গরু-ছাগল বিক্রির গড় চিত্র থেকে চলতি বছরের সম্ভাব্য বিক্রির ধারণা তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা নাজমুল হুদা শামীম বলেন, ‘ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ইজারাকৃত হাটগুলো সরকারি নিয়ম অনুসরণ করেই বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আর সরকারি নিয়মে নির্ধারিত মূল্যের কমে হাট ইজারা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সেহেতু এক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম বা অবহেলা হয়েছে, এটা বলার কোনো সুযোগ নেই।’
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সরকারি নিয়ম মেনেই অস্থায়ী পশুর হাট ইজারা দেয়া হয়েছে।’