খবর৭১ঃ
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে নতুন পুরনো মিলে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি শরণার্থী শিবিরে এখন বসবাস করছে ১১ লাখ ১৯ হাজার রোহিঙ্গা। বন ও পাহাড় কেটে এসব রোহিঙ্গাদের বসতি গড়ে তোলায় গত দুই বছরে ধ্বংস হয়েছে কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের ছয় হাজার ২০০ একর বন। যার মধ্যে রয়েছে দুই হাজার ২৭ একর সৃজিত আর চার হাজার ১৩৬ একর প্রাকৃতিক বন।
বন বিভাগ বলছে, রোহিঙ্গাদের আগমনে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বনজ এবং জীববৈচিত্র্যের যে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৮৬৫ কোটি ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকার। গত ৩ জুলাই কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগ থেকে চট্টগ্রাম বন সংরক্ষক দফতরে পাঠানো এক প্রতিবেদনে এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, রোহিঙ্গাদের দ্বারা ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি প্রাথমিকভাবে যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সে প্রতিবেদনে সৃজিত বন, প্রাকৃতিক বন আর জীববৈচিত্র্য মূলত তিন ভাগে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। যা টাকার অংকে এক হাজার ৮৬৫ কোটি ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার ৮৩৫ টাকা।
সম্প্রতি বন বিভাগে পাঠানো এ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গার ঢল নামে। এর আগে আসাসহ নতুন-পুরনো মিলে বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে বসবাস করছে প্রায় ১১ লাখ ১৯ হাজার রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গারা বসবাস করছে উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, বালুখালী ঢালা, ময়নারঘোনা, তাজনিম-খোলা, মক্করার বিল, হাকিমপাড়া, জামতলি বাঘঘোনা, শফিউল্লাকাটা এবং টেকনাফের পুটিবুনিয়া ও কেরানতলী এলাকাসহ বন বিভাগের গেজেট ভুক্ত প্রায় ছয় হাজার ২০০ একর বনভূমিতে। রোহিঙ্গাদের আগমনে বন ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। টাকার হিসাবে সৃজিত এবং প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি হয়েছে ৪৫৬ কোটি আট লাখ তিন হাজার ৬৪০ টাকা। একইভাবে জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ৪০৯ কোটি ৪৮ লাখ ৫৪ হাজার ১৯৫ টাকা। সে হিসাবে বনজ এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির পরিমাণ টাকার হিসাবে এক হাজার ৮৬৫ কোটি ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার ৮৩৫ টাকা।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের হালনাগাদ প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে আরও বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে ক্যাম্পে দুই লাখ ১২ হাজার ৬০৭টি ঘর, আট হাজার ৫২৪টি নলকূপ, ৫২ হাজার ১৬৫টি টয়লেট, ১৩ হাজার ৭০৮টি গোসলখানা, ১৩ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন, ৩০ কিলোমিটার সড়ক, ত্রাণ সংরক্ষণের জন্য ২০টি অস্থায়ী গুদাম এবং ২০ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছে। স্থাপনার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এমনকি স্থাপনা নির্মাণের জন্য সরকারি-বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো ব্যাপকহারে পাহাড় কাটছে। পাহাড় কেটে ক্যাম্প ইনচার্জ, পুলিশ ক্যাম্প, বিভিন্ন সংস্থার অফিসের জন্য স্থায়ী অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। যা বন ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।
এছাড়াও বিশ্ব ব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে খুব শিগগিরই সেখানে তিনতলা বিশিষ্ট ২০টি সাইক্লোন শেল্টার, ৬০টি গভীর নলকূপসহ পানি সংরক্ষনাগার ও পানি সঞ্চালন লাইন, ২০টি ফিক্যাল স্লাজ ম্যানেজমেন্ট ইউনিট, ২০টি সেফটিক ট্যাংক, ছয়টি সাব স্টেশনসহ ৫০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, পর্যাপ্ত রাস্তা ঘাট, সেতু কালভার্ট এবং অন্যান্য অবকাঠামো তৈরি করা হবে। এসব প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে উখিয়া-টেকনাফের বনভূমি ও বনজ সম্পদ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে বলে প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন বলছে, কক্সবাজার জেলার পাহাড়গুলো প্রধানত নরম ও দো-আঁশ মাটির হওয়ায় মাটির কাঠিন্য বা দৃঢ়তা কম। ফলে টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসের আশঙ্কা বেড়ে যায়। গত বর্ষা মৌসুমেও পাহাড় ধসে অনেক ক্ষতি হয়েছে। উখিয়া ও টেকনাফে পাহাড় এবং বনভূমি কেটে অপরিকল্পিত রোহিঙ্গা বসতি গড়ে তোলায় বর্ষায় পাহাড় ধসের আশঙ্কাও রয়েছে।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, রোহিঙ্গারা আসার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বনের। বনভূমিতেই তাদের জন্য আবাসস্থল তৈরি করা হয়েছে। বন পরিবেশের এ ক্ষতি কোনোভাবেই পোষানো সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করি কিছুটা হলেও বনের ক্ষতি পোষানো যাবে।