খবর৭১ঃ রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গুজ্বর। ৬৪ জেলাতেই এখন ডেঙ্গুর বিস্তার। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর তালিকাও। সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত মহামারী ঘোষণা করা হয়নি। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতি আর কয়েকদিন অব্যাহত থাকলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
বৃহস্পতিবার চলতি মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও এক হাজার ৭১২ জন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। অর্থাৎ প্রতি মিনিটে ১ জনের বেশি ভর্তি হয়েছেন। একই দিন নতুন করে আরও পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এদিকে জ্বরে আক্রান্ত যে কোনো রোগীর ক্ষেত্রেই ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা না করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসক বা নিকটস্থ হাসপাতালের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের মতে, গুরুতর পরিস্থিতিতে শুধু সিবিসি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট) পরীক্ষা করে, কী ধরনের চিকিৎসা দিতে হবে সেটি নির্ধারণ করা সম্ভব। এমনটি করা হলে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানোর জন্য রোগীকে ভোগান্তিতে পড়তে হবে না। বিলম্ব হবে না চিকিৎসা শুরু করতে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক আয়েশা আক্তার জানান, নতুন আক্রান্তদের মধ্যে এক হাজার ১৫০ জনই রাজধানীতে।
সব মিলিয়ে চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৫১৩ জন। বুধবার এ সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার ১৮৩ জন। সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ১৪ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হলেও বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়ে গেছে। শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই এ রোগে ১০ জনের মৃত্যু ঘটেছে।
আইইডিসিআরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ পর্যন্ত সেখানে ২০ জন মৃত ব্যক্তির নমুনা এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, রাজধানীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাইরেও ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন জেলার হাসপাতালগুলোতে ৩ হাজার ৪৬৪ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
ডেঙ্গু নিয়ে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২২২ জন রয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। নতুন-পুরনো মিলিয়ে বর্তমানে এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৭০৬ জন। এরপর মিটফোর্ড হাসপাতালে ৩৩৭ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ১৩২, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৩২২, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ১৯৭, বারডেম হাসপাতালে ৫৭, বিএসএমএমইউতে ১২৭, পুলিশ হাসপাতালে ১৬৫, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৮৭, বিজিবি হাসপাতালে ৩০, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৩০৫ এবং সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৪৩ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে সর্বমোট চার হাজার ৩৩২ জন ভর্তি রয়েছেন।
রাজধানীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৩৯ জন, স্কয়ার হাসপাতালে ১২৫, ধানমিণ্ড সেন্ট্রাল হাসপাতালে ১০৬, ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতলে ১১১, সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে ১০৭ এবং আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০৪ জন।
রাজধানীর বাইরে ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোতেই সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ১৪৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৪ জন, খুলনা বিভাগে নতুন ৭৬ জন, বরিশাল বিভাগে নতুন ৬৩, ময়মনসিংহ বিভাগে নতুন ৬২, রাজশাহী বিভাগে নতুন রোগী ৫৮, রংপুর বিভাগে নতুন রোগী ৩৩ এবং সিলেট বিভাগে নতুন শনাক্ত ৩১ জন।
রাজধানীসহ সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় দেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ডেঙ্গু পরীক্ষার (এনএস১) কিট, (আইজিজি ও আইজিএম) কিট এবং সিবিসির রি-এজেন্টের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে।
রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিকগুলোতে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে রোগীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এতে রোগ নির্ণয়ে দেরি হচ্ছে এবং রোগীর চিকিৎসা প্রক্রিয়া শুরু করতেও বিলম্ব হচ্ছে। অথচ এসব ক্ষেত্রে পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে, রোগীর প্রাথমিক লক্ষণ দেখেই চিকিৎসা শুরু করা উচিত। যাতে দ্রুত রোগীর সুস্থতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
রোগতত্ত্ব রোগনিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) একটি সূত্র জানায়, ২০০৯-১১ পর্যন্ত দেশে সোয়াইন ফ্লু’র প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। এ রোগের পরীক্ষা তখন আইইডিসিআর-এ করা হতো। জ্বরে আক্রান্ত এত বেশি মানুষ তখন পরীক্ষা করতে আসত যে লাইন আধা কিলোমিটারের বেশি লম্বা হয়ে যেত। পরিস্থিতির বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরামর্শে তখন রোগের লক্ষণ দেখেই চিকিৎসা দেয়ার নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. শফি উল্লাহ মুনসি যুগান্তরকে বলেন, যখন কোনো দেশে ডেঙ্গুর মতো ভাইরাস সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তখন সেটি সব রোগীর ক্ষেত্রে পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এসব ক্ষেত্রে সিবিসি পরীক্ষা করিয়ে রক্তে প্লাটিলেটের অবস্থা দেখেই চিকিৎসা শুরু করা উচিত।
পাঁচজনের মৃত্যু : ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীসহ সারা দেশে আরও পাঁচজনের মৃত্যুর তথ্য জানা গেছে। নওগাঁর আত্রাইয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আবদুল ওয়াহেদ (৭৫) নামে সাবেক এক প্রধান শিক্ষকের মৃত্যু হয়েছে। ভৈরবে হামজা (১২) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। টেকনাফে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে আবদুল মালেক (৩৩) নামে এক কাপড় ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া মাদারীপুরের শিবচরের ফারুক খান (২২) এবং ফরিদপুরের শারমিন আক্তার (২৫) নামের এক তরুণীর মৃত্যু হয়েছে।
এক কোটি ৬১ লাখ পিস কিট আমদানি : সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট সরবরাহ নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। ইতিমধ্যে সাতটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১ কোটি ৬১ লাখ পিস ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট আমদানির পূর্বানুমোদন প্রদান করেছে। যার একটি অংশ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে পৌঁছেছে।
বৃহস্পতিবার মেসার্স এসটিপি ৬৫ হাজার পিস ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট আমদানি করে। যার মধ্যে ঢাকা শহরের মিটফোর্ড এলাকার বিভিন্ন মেডিকেল ডিভাইস বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান/হাসপাতালে ৩৫ হাজার পিস, চট্টগ্রামের বিভিন্ন মেডিকেল ডিভাইস বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান/হাসপাতালে ১৫ হাজার পিস এবং বিএমএ ভবনের বিভিন্ন বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানে ১৫ হাজার পিস ডেঙ্গু কিট সরবরাহ করা হয়েছে।
এ ছাড়া এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আরও ৬৫ হাজার পিস ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট আজ এসে পৌঁছাবে। মেসার্স হেলথ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সলুশন লিমিটেড ২ লাখ ২৫ হাজার পিস ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট এবং মেসার্স অরবিটাল ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশনের অধীন ২ লাখ পিস ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কিট আজ দেশে পৌঁছাবে বলে জানিয়েছে ঔষধ প্রশাসন।
সারা দেশের চিত্র : বিভিন্ন ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনে দেখা গেছে, টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু পরীক্ষা করার কোনো ব্যবস্থা নেই। সেখানকার স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা ডা. সুমন বড়ুয়া এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। একই অবস্থা নওগাঁর নিয়ামতপুরে। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. নূল আলম দীন জানান, হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই।
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক কামদা প্রসাদ সাহা জানিয়েছেন, ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা এখনও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কষ্টকর হয়ে পড়বে। সিলেটের সিভিল সার্জন হিমাংশু লাল রায় জানিয়েছেন, সিলেটে এডিস মশার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। প্রতিটি উপজেলায় অতিরিক্ত শয্যা সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং একটি করে মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
শেরপুর জেলা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. খাইরুল কবির সুমন বলেন, সামনে ঈদের সময় ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসা লোকজনের চাপ বাড়বে। তখন ডেঙ্গু পরিস্থিতি হয়তো জটিল হতে পারে। বরিশালে এডিস মশার সন্ধান মিলেছে।
শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন ওয়াডের রেজিস্ট্রার ডা. এইচএম মাসুম বিল্লাহ জানান, প্রতিদিনই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। লোকবলের অভাবে নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। মেডিসিন বিভাগ ১, ২, ৩ ও ৪-এ বেড সংকট রয়েছে। বেড কম না থাকায় রোগীদের ফ্লোরে রেখে চিকিৎসাসেবা দিতে হচ্ছে।
যশোর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, সেখানে কিটের অভাব রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরে চাহিদা পাঠানো হয়েছে।
দিনাজপুরে ডেঙ্গু রোগীদের খোঁজখবর ও ২৪ ঘণ্টা প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা সেবার উদ্বোধন করেছেন হুইপ ইকবালুর রহিম। সিলেট মহানগরীকে ডেঙ্গুমুক্ত করতে স্বাস্থ্য ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মীদের ছুটি বাতিল করেছে সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। রাজশাহীতে সাংবাদিক ফেরদৌস ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে