খবর৭১ঃ কমলাপুর রেলস্টেশনে সাড়ে ১৯ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পরও মঙ্গলবার রাজশাহী সিল্ক সিটির ৮ আগস্টের টিকিট পাননি লোকমান হোসেন।
সন্তানসম্ভবা স্ত্রী, ২ ও ৪ বছরের দুই সন্তানকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য ৯ আগস্টের টিকিটের জন্য ফের লাইনে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন লোকমান।
ঈদের অগ্রিম টিকিট নিয়ে ‘লুকোচুরি’র সঙ্গে ভিআইপিদের নামে টিকিট ব্লক করে রাখায় মঙ্গলবার কমলাপুর রেলস্টেশনসহ বাকি ৪ স্টেশনেও টিকিটের জন্য হাহাকার লেগে ছিল।
বিস্তর অভিযোগ ওঠে অনলাইন ও রেল অ্যাপসে টিকিট বিক্রি নিয়েও। টিকিট ছাড়ার ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই বেশির ভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রি হয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
মঙ্গলবার কমলাপুরে ২৫-৩০ হাজার লোক টিকিটের জন্য জড়ো হলেও তাদের ব্যবহারের জন্য ছিল না পর্যাপ্ত টয়লেট। ফ্যানের অভাবে প্রচণ্ড গরমে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সর্বত্রই ছিল অব্যবস্থাপনার চিত্র।
একেকজন সর্বোচ্চ ৪টি টিকিট কাটতে পেরেছেন। সে হিসাবে অধিকাংশ লোককেই ফিরতে হয়েছে খালি হাতে।
অধিকাংশ কেবিন কিংবা এসি চেয়ারের টিকিট ‘ভিআইপি’দের জন্য রাখায় অনেকে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও কাঙ্ক্ষিত টিকিট পাননি।
বিমানবন্দর, তেজগাঁও, বনানী ও ফুলবাড়িয়া পুরাতন রেলভবন স্টেশনেও ছিল প্রায় একই অবস্থা। রাজশাহীগামী সিল্ক সিটি এক্সপ্রেস ট্রেনের সিঙ্গেল কেবিনের টিকিট কাটতে সোমবার দুপুর পৌনে ৩টায় কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন লোকমান হোসেন।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় তার সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, প্রায় ১৯ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও কাঙ্ক্ষিত টিকিট পেলাম না। ৭ জনের পেছনে ছিলাম। কেবিন না পেয়ে এসি চেয়ারের জন্য অনুনয় বিনয় করেও ব্যর্থ হয়েছি। এখন ৯ আগস্টের টিকিটের জন্য ফের লাইনে দাঁড়াব।
প্রতিদিন ৩৪টি আন্তঃনগর ট্রেনের মোট ২৫ হাজার ৮৯৪টি টিকিট ছাড়া হয়। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ১২ হাজার ৯৪৭টি টিকিট কাউন্টার এবং বাকি টিকিট অনলাইন ও রেল অ্যাপসে বিক্রির কথা।
মঙ্গলবার অনলাইনে ১০ হাজার ৭২২টি বিক্রির জন্য বরাদ্দ ছিল। বাকি ১৫ হাজার ১৭২টি টিকিট কাউন্টার থেকে। কাউন্টারের সামনে টিকিটের হিসাব উল্লেখ থাকার কথা থাকলেও তার কোনো কিছুই ছিল না। অন্য স্টেশনেও ছিল একই অবস্থা।
কথা হয় সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট কিনতে আসা যাত্রী বিল্লাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে জানান, কাউন্টার এবং অনলাইনের টিকিট নিয়ে লোকোচুরি চলছে। কোনো কাউন্টারের সামনেই টিকিটের হিসাব নেই।
৭ আগস্ট অনলাইন-রেলঅ্যাপসে টিকিট কাটতে না পেরে সোমবার বেলা ১১টায় বিমানবন্দর রেলস্টেশন কাউন্টারে আসি। জানতে পারি সকাল ১০টার মধ্যেই সোনারবাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট বিক্রি শেষ হয়ে গেছে।
কমলাপুর স্টেশন থেকে সমগ্র পশ্চিমাঞ্চলগামী ট্রেন এবং বিমানবন্দর স্টেশন থেকে সমগ্র পূর্বাঞ্চলগামী ট্রেনের টিকিট বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু টিকিট না পেয়ে শত শত লোককে ফিরে যেতে হয়েছে।
কমলাপুরে টিকিট কিনতে আসা যাত্রীদের দুর্ভোগের আরেক নাম টয়লেট বিড়ম্বনা। হাজার হাজার লোকের জন্য একটি মাত্র টয়লেট। স্টেশনের ভেতরে ভিআইপি, প্রথম শ্রেণি এবং নতুন নির্মাণ করা আধুনিক টয়লেট (৮ কক্ষবিশিষ্ট) থাকলেও তা যাত্রীরা ব্যবহার করতে পারেননি।
‘দ্বিতীয় শ্রেণির বাহির’ গেটের বাম পাশে ছোট্ট রুমের ভেতর একটি মাত্র টয়লেট, যেটি মেয়েরা ব্যবহার করলেও পুরুষদের জন্য একটিও নেই। প্রতিদিনই টিকিট কিনতে আসা প্রায় ২৫-৩০ হাজার লোককে টয়লেট বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। কমলাপুরে ২৩টি কাউন্টারের মধ্যে মাত্র একটি কাউন্টার রয়েছে (মহিলা ও প্রতিবন্ধী) মহিলাদের জন্য।
কাউন্টারের সামনের পিলারগুলোতে আগে ফ্যান থাকলেও এবার তা উধাও হয়ে গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা জানান, ভিআইপিদের জন্য টিকিট রেখে দেয়া হচ্ছে। তাদের কারণে সাধারণ যাত্রীরা বঞ্চিত হচ্ছে। আর প্রতিদিনই ভিআইপিদের চাহিদাপত্র আসছে। যাচাই-বাছাইয়ের সময়ও পাচ্ছি না।
তাদের জন্য সাধারণ টিকিট নয়, রাখতে হচ্ছে কেবিন সিট এবং এসি চেয়ার। ফলে কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও টিকিট না পেয়েই ফিরে যেতে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের।
ভিআইপি কালচার বন্ধ হলেই কেবল এসব টিকিট সাধারণ যাত্রীদের ভাগ্যে জুটবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জিন্নাত-আরা-সিমু জানান, আমরা তিন বান্ধবী এসেছি খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেসের টিকিট কিনতে। কেবিন সিট কিংবা এসি চেয়ার সিট নেই বলে কাউন্টার থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাগ্যে জোটেনি শোভন চেয়ারও।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উম্মে জাহান সুইটি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছিলেন, ভিআইপি আসলে কারা। ভিআইপিদের জন্য সাধারণ মানুষের টিকিট কেন। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের এক কর্মকর্তা জানান, গত ঈদে এমপি, মন্ত্রী, সচিব ও বিচারপতিদের নামে যে পরিমাণ ভিআইপি টিকিট গেছে, তাদের মধ্যে ১০ শতাংশেরও কম এমপি, মন্ত্রী, সচিব ও বিচারপতিগণ ভ্রমণ করেছেন। তাদের নাম ভাঙিয়ে তাদের স্বজন কিংবা দলীয় লোকজনরাই ভ্রমণ করেছেন।
এদিকে রেলওয়ের ই-সেবা প্রদানকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম (সিএনএস) লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক জিয়াউল আহসান সরোয়ার জানান, তারা স্বচ্ছতার সঙ্গে টিকিট বিক্রি করছেন। যা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে তা কাউন্টার ও অনলাইনে ছাড়া হচ্ছে। একটি টিকিটের বিপরীতে শত শত লোক এক ঙ্গে ঢুকছেন।
অনুরূপ কাউন্টারেও। তিনি বলেন, মঙ্গলবার ১০ হাজার ৭২১টি টিকিট অনলাইনে ছাড়া হয়। বিকাল ৪টা পর্যন্ত ৯ হাজার ২৪২টি টিকিট বিক্রি হয়েছে। সীমিত টিকিট থাকায় সবাই টিকিট পাচ্ছেন না বলেও তিনি জানান। কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ আমিনুল হক জুয়েল যুগান্তরকে জানান, ৮ আগস্টের জন্য ৩৪টি আন্তঃনগর ট্রেনে ২৫ হাজার ৮৯৪টি এবং তিনটি ঈদ স্পেশাল ট্রেনের জন্য ১ হাজার ৯৯১টি টিকিট ছাড়া হয়।
মঙ্গলবার কমলাপুর স্টেশনে প্রায় ১৩ হাজার টিকিটের বিপরীতে ২৫-৩০ হাজার লোক লাইনে ছিল। সীমিত টিকিট, সবাই পাবে না এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, প্রতিদিন সাধারণ টিকিট বিক্রি হচ্ছে, তবে ভিআইপি টিকিট পরে দেয়া হবে।
টিকিট বিক্রিতে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না, যারা টিকিট পাচ্ছে না তারাই অপপ্রচার করছে। আজ ৯ আগস্টের, ১ আগস্ট ১০ আগস্টের এবং ২ আগস্ট ১১ আগস্টের অগ্রিম টিকিট বিক্রি করা হবে।