খবর৭১ঃ
বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী ও রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এর আগে মিন্নিকে গ্রেপ্তার করা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। আইনজ্ঞরা বলছেন, রিফাত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে মিন্নির কাছ থেকে আদালতে স্বীকারোক্তি আদায় করার প্রক্রিয়াটি বেআইনি ও সংবিধানবহির্ভূত।
মিন্নিকে গ্রেপ্তার করার পর আদালতে হাজির করে রিমান্ডে (জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজত) নেওয়ার আবেদন করা হয় গত বুধবার। তাঁকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। ওই দিন মিন্নির পক্ষে কোনো আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেননি। অভিযোগ আছে, কোনো আইনজীবী নিয়োগ করতে দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি মিন্নির পক্ষে আইনজীবী নিয়োগে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কেউ গ্রেপ্তার হলে তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ পাওয়া সাংবিধানিক অধিকার। আইনজীবীর সঙ্গে আদালত কক্ষে পরামর্শ করার অধিকারও আছে আইনে। কিন্তু মিন্নি ওই সব অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এরপর তাঁর কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের বিষয়টি অস্বাভাবিক ও বেআইনি বলে অভিমত দিয়েছেন বিশিষ্ট আইনজীবীরা।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে রিমান্ডে নিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করানো হয়। প্রথমত, আসামিকে স্পষ্টতই চাপ প্রয়োগ করা হয়, ভয়ভীতি দেখানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে এর চেয়েও বেশি কিছু করা হয়। এই প্রক্রিয়াই বেআইনি। দ্বিতীয়ত, রিমান্ডের আগে-পরে আসামিকে আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না। পরামর্শ করতে দেওয়া হয় না। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি।
শাহদীন মালিক আরো বলেন, ‘রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও স্বীকারোক্তি নেওয়ার প্রক্রিয়া সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী ও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তবে আমরা প্রায় সব ক্ষেত্রেই বেআইনি প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ফলে আইনবহির্ভূত পদক্ষেপ নীরবে মেনে নিতে হচ্ছে।’
২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট কোনো আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে কিভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছিলেন এক রায়ে। সে রায় ২০১৬ সালের ২৫ মে বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, আসামিকে কারাগারের মধ্যে একটি কাচের দেয়ালঘেরা কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। ওই কক্ষের বাইরে আইনজীবী থাকবেন। এ ছাড়া আসামির স্বজনরাও থাকবে। ওই প্রক্রিয়ায় জিজ্ঞাসাবাদের প্রচলন নেই দেশে। আর মিন্নির ক্ষেত্রে আইনজীবী নিয়োগের সুযোগই হয়নি। কাজেই বলা যায়, তার স্বীকারোক্তি আদায় সম্পূর্ণ বেআইনি।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট ফৌজদারি আইনজীবী মো. বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘মিন্নি জড়িত কি জড়িত না সেটা আমরা কেউ জানি না। আদালতে তিনি কী বলেছেন, তা সত্যি কি মিথ্যা সেটাও আমরা জানি না। সবই হতে পারে। তবে তাঁকে রিমান্ডে নেওয়া, রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রক্রিয়া ও পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে দুই দিনের মধ্যে আদালতে হাজির করা—পুরো প্রক্রিয়াটাই অস্বাভাবিক মনে হয়।’ তিনি আরো বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় না। আইনজীবী তার পক্ষে দাঁড়াতে না পারাটা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘একটি হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষীও আসামি হতে পারে। তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে মিন্নিও আসামি হতে পারেন। তবে আইনি যেসব অধিকার পাওয়ার কথা, তাঁকে তা দেওয়া না হলে সেই প্রক্রিয়ায় স্বীকারোক্তি আদায় বৈধ হতে পারে না।’
জানা যায়, মিন্নিকে গ্রেপ্তার দেখানোর আগে কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়। সেখানে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে মিন্নিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। রিমান্ডে নেওয়ার আগেই পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, মিন্নি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। যদি রিমান্ডে নেওয়ার আগেই তিনি স্বীকার করে থাকেন, তবে তাঁকে রিমান্ডে নেওয়ার প্রয়োজন হলো কেন সে প্রশ্নটি সামনে এসেছে।
পুলিশের ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে সম্প্রতি মামলা হয়েছে। তাঁকে জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে সম্প্রতি। অথচ একজন নারীকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা বা বেআইনি প্রক্রিয়ায় জিজ্ঞাসাবাদ করা কতটা যুক্তিসংগত তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
রিফাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পর তার মা গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, নয়ন বন্ডের সঙ্গে পুলিশেরও নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সেই পুলিশের দ্বারা রিফাত হত্যা মামলার তদন্তও প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করেন আইনজীবীরা।