খবর ৭১ঃ
ত্বক আর চুল যতটা আদর পায়, হাত-পা সেই তুলনায় কিছুই না। আর তার থেকেও বেশি অবহেলা নখের। অথচ বিয়েবাড়ি কিংবা কোনও অনুষ্ঠানে পোশাকের সঙ্গে মানানসই নেলপলিশ পরতে কিন্তু আমরা ভুলি না। অনেকেই মনে করেন, সাজগোজ বা যত্নের ওখানেই ইতি! আবার খাতির করে নখের যত্ন নেওয়া মানেই বাড়াবাড়ি। ভেবে দেখুন, কারোর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ থেকে বিদায় অবধি, সব পরিচয় কিন্তু হাতে হাতেই হয়। সুতরাং হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত এগিয়ে দিলেন, অথচ নখের তখন যাচ্ছেতাই অবস্থা! কী ইমপ্রেশন পড়বে বলুন তো! অথবা সুন্দর একটা স্টিলেটো পায়ে গলিয়েছেন অফিস পার্টিতে যাবেন বলে। কিন্তু পায়ের দিকে নজর দিতে গিয়ে দেখলেন সেখানেও একই অবস্থা। সুন্দর ত্বক এবং চুল যেমন আপনার সৌন্দর্যের বহিপ্রকাশ, তেমনই হাত বা পায়ের নখের মতো সামান্য অংশগুলোও কিন্তু আপনার চারিত্রিক বৈশিষ্টই প্রকাশ করে। নখের সঠিক যত্ন না নিলে, সৌন্দর্য অসম্পূর্ণ। সুন্দর পোশাক পরে যত্ন করে সেজেছেন, অথচ হাতে পুরনো, উঠে যাওয়া নেলপলিশ, কিংবা অসমান নখ থাকলে তা মোটেও শোভনীয় হবে না। নিয়মিত যত্ন করা, পরিষ্কার করে শেপ করা, নেলপলিশ পরা নখ আপনার ব্যক্তিত্বকে অনেকাংশেই প্রভাবিত করতে পারে। সুতরাং নখের দিকেও একটু নজর দিন।
নখের সাধারণ যত্নঃ
নখের যত্ন নেওয়া কোনও রকেট সায়েন্স নয়। সময়ও চাই নামমাত্র। আর সামগ্রী বলতে প্রয়োজন হবে নেল ফাইল, নেল কাটার, নেলপলিশ রিমুভার এবং পছন্দের নেল পলিশ। মাসে দু’বার এইটুকু যত্ন নিলেই দেখবেন, নখের ভোল পালটে গেছে। প্রতি দু’সপ্তাহ অন্তর নখ পরিষ্কার করতে ভুলবেন না। পুরনো নেলপলিশ তুলে নখ কেটে শেপ করুন। একবার নেলপলিশ তুললে এবং খুব প্রয়োজন না পরলে, চেষ্টা করুন অন্তত এক সপ্তাহ নখে অন্য কোনও নেলপলিশ না পরতে। এতে নখ হলুদ হয়ে যায়। মাসে দু’বার এইটুকু যত্ন নিলেই দেখবেন, নখের অনেক সমস্যা কমে যাবে। তবে পার্লারের খরচা কমাতে চাইলে বাড়িতেই কিন্তু ম্যানিকিওর এবং পেডিকিওর করে নিতে পারেন।
- প্রথমে নখের পুরনো নেলপলিশ তুলে নখ কেটে ফাইল করে নিন।
- এবার একটি বড় পাত্রে ঈষদুষ্ণ জল নিয়ে তাতে অল্প মাইল্ড শ্যাম্পু এবং কয়েকফোঁটা ল্যাভেন্ডার অয়েল মিশিয়ে তাতে হাত এবং পা ডুবিয়ে রাখুন। প্রয়োজন হলে এতে সামান্য রক সল্টও মেশানে পারেন। ২০ মিনিট রাখার পর ব্রাশ দিয়ে নখ ভালভাবে ঘষুন। নখের কোণে যেন কোনও ময়লা না জমে থাকে।
- এবার জল থেকে হাত এবং পা তুলে, নরম তোয়ালে দিয়ে চেপে চেপে মুছে নিন। পছন্দের হ্যান্ড অথবা ফুট মাস্ক লাগিয়ে আরও ২০ মিনিট অপেক্ষা করুন। অথবা একটা ডিমের কুসুম, ২ চামচ লেবুর রস, একচামচ নারকেল তেল এবং একচিমটে দারচিনি গুঁড়ো একসঙ্গে মিশিয়ে হাতে এবং পায়ে লাগান। শুকিয়ে গেলে ভিজে হাতে ঘষে ধুয়ে নিন।
- এই স্টেপটা অপশনাল। যদি সালঁর মতোই ফল পেতে চান, তবেই করুন। না করলেও অসুবিধা নেই। আজকাল বাজারে নানা ধরনের কিউটিকল ক্রিম পাওয়া যায়। এতে নখের গোড়ায় জমে থাকা কিউটিকল পরিষ্কার করা হয়, যাতে নখের গ্রোথ ভাল থাকে। সামান্য পরিমাণে এই ক্রিম নিয়ে নখে লাগিয়ে রাখুন। কিছুক্ষণ রেখে অরেঞ্জ স্টিক দিয়ে কিউটিকল ঘষলেই দেখবেন সাদা সাদা পদার্থ উঠে আসবে। ভালভাবে সব নখ পরিষ্কার করে ধুয়ে ফেলুন।
- এবার হাত-পা মুছে সামান্য ময়শ্চারাইজ়ার লাগিয়ে নিন।
- প্রয়োজন থাকলে নেলপলিশ লাগাতে পারেন। না হলে বেসকোট লাগিয়ে নিন।
মাসে একবার বাড়িতেই এভাবে যত্ন নিলে সালঁতে গিয়ে আলাদা করে পেডিকিওর বা ম্যানিকিওর করানোর কোনও প্রয়োজন পড়বে না। নখও সুন্দর থাকবে। তবে সবার নখ তো একই রকম নয়। কারও কারও নখে অন্যান্য সমস্যাও থাকে। চলুন, সেই সমস্যাগুলোর প্রতিকার জেনে নিই।
ভঙ্গুর নখের সমস্যাঃ
অনেকের নখই খুব নরম হয়। ফলে অল্প চাপেই নখ ভেঙে যায়। এই ধরনের নখ বড় করাও যায় না। নানা কারণে এই সমস্যা হতে পারে। নখের মূল উপাদান কেরাটিন। এই কেরাটিন সঠিকভাবে তৈরি না হলে নখ ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা বেশি হয়। এই কারণে অনেকের নখ এমনিই নরম হয়। আবার যাঁরা সারাদিন সংসারে ব্যস্ত থাকেন, তাঁদের ক্ষেত্রে জলে ভিজে থাকতে থাকতেও নখ নরম হয়ে যেতে পারে। কারণ যাই হোক, নখ বড় করতে গেলে একটু যত্ন নিন।
- আধকাপ নারকেল তেল সামান্য গরম করে তাতে নখ ডুবিয়ে রাখতে পারেন। অথবা এতে কয়েকফোঁটা পাতিলেবুর রস মিশিয়ে নিন। রাতে শুতে যাওয়ার আগে এই মিশ্রণে নখ ১০ মিনিট ডুবিয়ে রেখে গ্লাভস পরে শুতে যান।
- নখে ময়শ্চারাইজেশনের অভাবে আর্দ্রতা স্বাভাবিক না থাকলেও নখ ভেঙে যেতে পারে। আর নখের আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য ভিটামিন-ই তেল সবথেকে ভাল। বিউটি স্টোর থেকে ভিটামিন-ই ক্যাপসুল কিনতে পারেন। এই ক্যাপসুল ভেঙে নখে লাগিয়ে রাখুন। সারারাত লাগিয়ে রাখবেন। দু’সপ্তাহ প্রতিদিন করলেই উপকার পাবেন।
- নখ শক্ত করতে অ্যাপেল সিডার ভিনিগারও কার্যকরী। সমপরিমাণে খাঁটি অ্যাপেল সিডার ভিনিগার এবং জল মিশিয়ে কিছুক্ষণ নখ ডুবিয়ে রাখুন। এরপর একটা অরেঞ্জ স্টিক দিয়ে নখের কিউটিকল পেছনের দিকে ঠেলুন। কিছুদিন এভাবে করলে নখ শক্ত হবে।
নখের হলদেভাব কাটাতেঃ
এই সমস্যাও খুবই কমন। দাঁতের মতোই নখেও হলুদ ছোপ পড়ার প্রবণতা থাকে। মূলত নখে দীর্ঘদিন নেলপলিশ পড়ে থাকলে এবং সঠিক যত্ন না নিলে, হলদেভাব দেখা দেয়। নখে হলদে ছোপ থাকলে, তা দেখতে ভাল লাগে না। ফলে তা ঢাকতে আবারও নেলপলিশ লাগিয়ে রাখতে হয়, যা নখের পক্ষে ক্ষতিকারক।
- নখে দীর্ঘদিন নেলপলিশ পরা বন্ধ করুন। নেলপলিশ পড়লে অবশ্যই বেস কোট লাগিয়ে নেবেন।
- প্রতিবার নেলপলিশ রিমুভার দিয়ে তুলে, বাফিং বোঁডের সাহায্যে নখের ওপরের স্তর ঘষে তুলে ফেলুন।
- লেবুর রসের থেকে কার্যকরী আর কিছু নেই। লেবুর অ্যাসিড নখের হলদেভাব কমাতে সাহায্য করে। নখে পাতিলেবুর টুকরো ঘষে মিনিট ১৫ রেখে ধুয়ে ফেলুন।
- আজকাল বাজারে বিভিন্ন হোয়াটনিং টুথপেস্ট পাওয়া যায়। এতেও নখের হলদেভাব কেটে যায়। নখে এই জাতীয় টুথপেস্ট লাগিয়ে রাখুন। শুকিয়ে গেলে অল্প জল দিয়ে ব্রাশের সাহায্যে নখ ভাল করে ঘষে নিন। নিয়মিত ব্যবহারে পার্থক্য চোখে পড়বে।
- বেকিং সোডাও খুব ভাল অপশন। সামান্য বেকিং সোডা অল্প জলে গুলে পেস্ট বানিয়ে নিন। এই পেস্ট নখে লাগিয়ে রাখুন। ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।
ফাঙ্গাল ইনফেকশন কমাতেঃ
সাধারণত পায়ের নখেই নানা ধরনের ইনফেকশন বেশি দেখা যায়, তবে হাতের নখেও এই সমস্যা আসতে পারে। মূলত পায়ে বন্ধ জুতো পড়ে থাকার ফলে ঘাম জমে পায়ের নখে ফাঙ্গাল ইনফেকশন বেশি হয়। এছাড়া বর্ষাকালে রাস্তার নোংরা জল পায়ে লেগেও নানা ধরনের ইনফেকশন হতে পারে। এর থেকে বাঁচতে নখের যত্ন নিন। একই কারণে বিশেষত বর্ষাকালে নখের যত্ন নেওয়া বেশি প্রয়োজন।
- ইনফেকশন থেকে নখকে বাঁচাতে টি-ট্রি অয়েল ব্যবহার করে দেখতে পারেন। টি-ট্রি অয়েল যে কোনও ধরনের ইনফেকশন কমাতেই উপকারী। তবে সরাসরি কোনও এসেনশিয়াল অয়েল ত্বকে লাগাবেন না। সবসময় অন্য কোনও উপাদানের সঙ্গে মিশিয়ে নেবেন। সামান্য টি-ট্রি অয়েলের সঙ্গে অল্প অলিভ অয়েল মিশিয়ে তুলোয় করে ইনফেকশনের জায়গায় লাগাতে পারেন। প্রয়োজন পড়লে অল্প অরেঞ্জ অয়েলও মিশিয়ে নিতে পারেন।
- বেকিং সোডা শুধুমাত্র নখের হলদেভাব কাটাতেই নয়, নানা ধরনের ইনফেকশন কমাতেও সাহায্য করে। তবে মনে রাখবেন, বেকিং সোডা ফাঙ্গাসকে নষ্ট করে না। ফাঙ্গাসের বৃদ্ধি বা ছড়িয়ে পড়া থেকে আটকায়। বেকিং সোডার সঙ্গে সামান্য ভিনিগার মিশিয়ে নিলে, মিশ্রণে অ্যাসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, যা ইনফেকশন প্রতিরোধ করতে আরও বেশি কার্যকরী। একটা বড় পাত্রে জল নিয়ে তাতে এক কাপ ভিনিগার এবং ৪-৫ টেবলচামচ বেকিং সোডা মিশিয়ে নখ ডুবিয়ে রাখুন। ১৫ মিনিট পর পা তুলে ভালভাবে শুকিয়ে নিন। কয়েকদিন করলেই উপকার পাবেন।
- আমরা যে বাজার-চলতি মাউথওয়াশ ব্যবহার করি, তাও নখের নানা ইনফেকশন কমাতে কার্যকরী। বড় পাত্রে জল নিয়ে তাতে এককাপ মাউথওয়াশ মিশিয়ে আধঘণ্টা নখ ডুবিয়ে রাখুন। এরপর কোনও নরম ব্রাশ দিয়ে আলতো করে ঘষুন। ধীরে ধীরে ইনফেকশন কমে নখ স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
টিপসঃ
- খুব পুরনো নেলপলিশ যেমন নখে রেখে দেওয়া ঠিক নয়, তেমনই পুরনো নেলপলিশ নখে লাগানোও ঠিক নয়। তাই চেষ্টা করুন একসঙ্গে অনেক নেলপলিশ জমিয়ে না রাখতে।
- নেলপলিশ লাগানোর পর ঠান্ডা জলে নখ ডুবিয়ে রাখতে পারেন। এতে নখ তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে।
- কখনও কখনও নখ অর্ধেকভাবে ভেঙে গেলে বা চিড় ধরে গেলে কেটে ফেলা ছাড়া উপায় থাকে না। তবে যদি সামনেই কোনও অনুষ্ঠান থাকে, তবে সামান্য পেপার অ্যাঢেসিভ টেপ নিয়ে ভাঙা নখের ওপর লাগান। এরপর ভালভাবে নখের শেপে ফাইল করে নেলপলিশ লাগিয়ে নিন। দেখবেন নখ একদম নতুনের মতোই হয়ে গেছে।
- দাঁত দিয়ে যদি নখ কাটার অভ্যেস এখনও থেকে থাকে, তাহলে অবিলম্বে তা ত্যাগ করুন। এতে দাঁতেরও ক্ষতি হয় এবং নখেরও। নখ এবড়োখেবড়ো হয়ে যায়, যা পরবর্তীকালে ঠিক করা কঠিন।