খবর ৭১ঃ দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান ও ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের পরও থামছে না ইয়াবা পাচার। বরং নতুন নতুন কৌশল বের করছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ইয়াবার ‘বাহক’ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে তারা। ‘নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে রোহিঙ্গা শিবিরে চলছে এ মাদকের ব্যবসা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ইয়াবাসহ ধরার পড়ার পর অনেকেই পরিচয় লুকায়। এ কারণে কী পরিমাণ রোহিঙ্গা ইয়াবা পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়ছে তার সঠিক সংখ্যা জানা কঠিন। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গত তিন বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রোহিঙ্গারা আসার পর কক্সবাজারে ইয়াবাসহ আটকের পরিমাণ বেড়েছে। একইসঙ্গে বেড়ে গেছে মাদক মামলা ও আসামি গ্রেফতারের সংখ্যাও। তবে সরকার মাদকের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে যাওয়ায় চলতি বছরে মাদকপাচার কিছুটা কমেছে।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ বলেন, অভাবের তাড়নায় রোহিঙ্গারা মাদকপাচারে জড়িয়ে পড়ছে। তবে লেদা শিবিরের ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলমের মতে, অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীরা রোহিঙ্গাদের এ কাজে লাগাচ্ছে। তবে তাদের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা শিবিরে মাদক প্রতিরোধে বিভিন্ন প্রচার চালানো হচ্ছে।
গত বছরের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়। এরপর বন্দুকযুদ্ধে কক্সবাজারে ১২১ মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে টেকনাফে ৬৯ ও উখিয়ায় দু’জন নিহত হন। এছাড়া ১০২ জন মাদক ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করেছেন।
মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের পর থেকে ইয়াবার পাচার বেড়ে গেছে। যে কারণে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ ও ২০১৮ সালে অনেক বেশি ইয়াবার চালান ও পাচারকারী ধরা পড়েছে। আবার রোহিঙ্গা শিবিরকে নিরাপদ মনে করে অনেক ইয়াবা কারবারি সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। এই সময়ে উখিয়া ও টেকনাফ থানায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মাদক মামলার সংখ্যাও শতাধিক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত এক বছরে কক্সবাজারের ৩৪ রোহিঙ্গা শিবিরে পাঁচ শতাধিকের বেশি মাদক বিক্রি ও সেবনের আখড়া গড়ে উঠেছে। ইয়াবা মজুতের জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে ঘনবসতিপূর্ণ এই ক্যাম্পগুলো। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের তালিকায়ও রয়েছে ১৩ নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গার নাম। রোহিঙ্গা শিবিরে যারা মাদকের সঙ্গে জড়িতরা তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কক্সবাজারের শিবিরের রশিদ উল্লাহ, নজির আহমদ, খতিজা বেগম, জকির আহমদ, কালা সেলিম, হামিত মাঝি, উম্মি নাহার, সেতেরা বেগম, মুমিনা বেগম, মো. সেলিম, উসমান, মো. জোবাইর, অলি আহমদ, মান্না, হাসিমুল্লাহ, মো. আমিন, সাহা আহমদ, নুর মিয়া।
র্যাব-১৫, বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ মাসে ৪৮ লাখ ২১ হাজার ৫৫১ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। আটক করা হয়েছে ৩১০ মাদকপাচারকারীকে। এছাড়া অভিযানে শুধু টেকনাফে ১০১ জন মারা গেছেন।
র্যাব-১৫ টেকনাফ ক্যাম্পের ইনচার্জ লেফটেন্যান্ট মির্জা শাহেদ মাহতাব বলেন, ‘দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর স্থানীয় অনেক ইয়াবা পাচারকারীও রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এ কারণে শিবিরগুলোতে আমাদের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। মাদকের সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস বলেন, ‘আত্মসমর্পণ ও বন্দুকযুদ্ধের কারণে স্থানীয় ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এ ব্যবসা করছেন না। এখন মূলত রোহিঙ্গারা ইয়াবা ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।’
টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ ফয়সল হাসান খান জানান, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মাদকের বিস্তার নিয়ে তারাও উদ্বিগ্ন। তবে ক্যাম্পগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সোমেন মণ্ডল বলেন, ‘স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীরা রোহিঙ্গাদের শুধু মাদক পাচারের কাজেই ব্যবহার করছে না, তাদের ক্যাম্পগুলোকে ইয়াবা মজুত ও লেনদেনের ঠিকানা হিসেবে বেছে নিয়েছে। কারণ, তারা জানে ক্যাম্পগুলো স্পর্শকাতর এলাকা হওয়ায় সেখানে যখন তখন অভিযান চালানো অসম্ভব।’