খবর৭১ঃ
লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
-চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
-সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
এদেশের একজন শিক্ষিত এবং অনুগত নাগরিক হিসেবে এই রাষ্ট্রটিকে নিয়ে যত ক্রিয়া-বিক্রিয়া, আমি তা মাঝে-সাঝে বিশ্লেষণের চেষ্টা করি। এদেশ আমাদের দিয়েছে উজাড় করে। অথচ প্রতিদানে কি দিয়েছি আমরা বাংলাদেশকে আর তার মানুষগুলোকে? ১৯৭১-এ স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বাংলাদেশের মানচিত্রে ভূ-ভাগ সংযোজিত হয়েছে সামান্যই। বরং দেশের উন্নয়নের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বেড়েছে অবকাঠামোগত উন্নয়নের চাহিদা আর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কমেছে দেশটির উৎপাদনশীল ভূ-খন্ড। তৈরি হয়েছে একের পর এক মহাসড়ক আর ইপিজেড। কমেছে শুধুই জমি। অথচ ’৭১-এর পর বাংলাদেশের পথ-পরিক্রমার এই প্রায় পঞ্চাশ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ, হয়েছে সাত থেকে প্রায় সতেরো কোটি। কিন্তু আজও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। শুধু কি তাই? কি দুধ, কি ফল-ফলাদি সবজি, ডিম কিংবা মাছ, কিংবা গম-ভুট্টা আর ধান, এই প্রতিটি উৎপাদনেই পৃথিবীতে সেরা দশে আমার দেশ। অথচ আমরা, এই দেশের মানুষেরা, একদিন এই দেশটিকে নিয়ে দাঁড় করিয়েছিলাম দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নের কাঠগড়ায়। বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে চোখ বুলালে দেখা যাবে খুব কম সময়ের জন্যই এদেশটি শাসন করেছে এদেশীয়রা। সেই কবে হাজার বছর আগে পাল রাজারা, আর তারপর এই তো সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। মাঝে শুধুই একের পর এক ঔপনিবেশিক শাসন। কে বসেনি এদেশের মসনদে? দীর্ঘ এ তালিকায় যেমন আছে মোগল আর বৃটিশরা, আছে তেমনি আফ্রিকার কালো কৃতদাসও। তবুও ফুরায়নি বাংলাদেশের প্রাচুর্য আর এর প্রতি শোষকের আকর্ষণ।
লক্ষণীয় অসীম যেমন বাংলাদেশের দেয়ার ক্ষমতা, তেমনি ঠিক একইভাবে অন্তহীন একে নিয়ে চলমান একের পর এক চক্রান্ত। বাংলাদেশের দীর্ঘ ইতিহাসে সবচাইতে গৌরবের ঘটনাটি হচ্ছে ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। আর তাই ‘৭১- কে ঘিরে চক্রান্তও বোধ করি সবচেয়ে বেশি। হাজার বছর পরে আবারও যখন স্বাধীন বাংলাদেশ, তখন রাষ্ট্র হিসেবে একে ব্যর্থ প্রমাণে কুশীলবদের সক্রিয়তাও একেবারেই এর জন্মের মুহূর্ত থেকেই। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা দেখেছি সিরাজ শিকদারদের তান্ডব, ‘৭৪-এর মানবসৃষ্ট মনন্তর আর সবশেষ ’৭৫-এ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ড। বাংলাদেশকে ব্যর্থ করতে এর আগে পরে ইতিহাসে সংযোজিত হয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড কিংবা জেল হত্যার মতো কালো অধ্যায়ও।
’৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাস এক কথায় ইতিহাস বিকৃতি আর তথ্য দুর্বৃত্তায়নের ইতিহাস। একে-একে বদলে গিয়েছিল সবকিছুই। বাংলাদেশ বেতার হয়েছিল রেডিও বাংলাদেশ আর মুক্তিযুদ্ধের প্রাণের স্লোগান জয় বাংলা হয়েছিল বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। বদলে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষকও। এমনকি এত রক্ত, ত্যাগ আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে যে পাকিস্তানকে পরাজিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনভাবে পথচলার শুরু, সেই পাকিস্তানও হয়ে গিয়েছিল শুধুই ‘হানাদার’। মাঝে পাঁচটি বছর বাদ দিয়ে ২০০৯ পর্যন্ত বছরের পর বছর এই যে বিকৃত ইতিহাসের চর্চা, তাতে বিভ্রান্ত হয়েছে এদেশের একের পর এক প্রজন্ম।
আর প্রজন্মের এই বিভ্রান্তিকে বিভ্রান্তির চরমে নিতে যোগ করা হয়েছে নানা মাত্রিক উপাদান, অসম্ভবকে করা হয়েছে সম্ভব আর অবিশ্বাস্য যা তাও গেলানো হয়েছে সত্যের চকলেট কোটিং-এ। রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধার, দেশদ্রোহী আর দেশপ্রেমিকের এমন জগাখিচুড়ি কেউ কোথাও দেখেনি আগে। ’৭৫ পরবর্তী এদেশের প্রতিটি মন্ত্রিসভায় এক বা একাধিক চিহ্নিত রাজাকারের অন্তর্ভুক্তি আমাদের চোখ সওয়া হয়ে গিয়েছিল। শুধু ব্যতিক্রম হয়েছে যখন ক্ষমতায় এসেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ নিয়ে বিস্তর শুনেছি, লিখেছি, বলতে শুনেছি, বলেছিও কম না। পাশাপাশি এটাও তো সত্যি যে, স্বাধীন বাংলাদেশে এমন একটি মন্ত্রিসভাও গঠিত হয়নি যেখানে অন্তত একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। যে সরকারগুলোর হাত ধরে বদলে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান আর ঘোষক কিংবা ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল আমাদের সংবিধানের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সেসব মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তগুলো অনুমোদনেও ছিল মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীদের অনুমোদন।
বিভ্রান্তিতো ছড়ানো হয়েছে আরও কতভাবেই। জাতিকে কেকের মতো কেটে-কেটে করা হয়েছে টুকরো-টুকরো। ’৭১-এ যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে কিংবা জীবন বাঁচাতে সীমান্তের ওপারে গিয়েছিলেন, বলতে শুনেছি তারা নাকি কলকাতায় বসে আয়েশের জীবন কাটিয়েছেন। ’৭১-এর অবরুদ্ধ ঢাকায় বসে যাদের সৌভাগ্য হয়েছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পুল সাইডে রোদ পোহানোর। তাদের মুখে অমন কথা শুনে অবাক হইনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দাবিদার কেউ-কেউ যখন বলেন যে- সে সময়ে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সবাই ছিল পাকিস্তানের দোসর আর প্রশ্ন তোলেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের দেশপ্রেম নিয়ে, তখন হতবাক হই বৈকি। এদের আস্পর্ধা এতটাই লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছিল যে, এই ক’দিন আগেও একমুখে মুক্তিযুদ্ধের গান গাইতে গাইতে এদের দেখেছি অন্যমুখে মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে।
ইদানীং অবশ্য অবাক হচ্ছি অন্য একটি কারণে। ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গায় ফিরিয়ে আনায় গত দশকব্যাপী যে নিরন্তর প্রয়াস, কেন যেন মনে হচ্ছে তার কিছুটা হলেও সুফল ক্রমশই দৃশ্যমান। আজকের যে প্রজন্ম ক’দিন আগেও রাজাকারের বিচারের দাবিতে শাহবাগ কাঁপিয়ে মনে আবার আশা জাগিয়েছিল, তাদের কেউ- কেউ এই সেদিন ‘আমি রাজাকার’ টি-শার্ট বুকে কিছুটা হলেও আমাদের আশাভঙ্গের কারণ হয়েছিল। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে ২০১৩’র শাহবাগের ধারাটিই প্রবলতর। এই প্রজন্মই দাবি তুলেছে রাজাকারের তালিকা প্রণয়নের।
’৭১-এ সীমানার এপার-ওপারের প্রতিটি বাঙালীই স্বাধীনতার একেকজন কা-ারী। ব্যতিক্রম শুধু মুষ্টিমেয় কিছু দালাল-কুলাঙ্গার। পাকিস্তানের পা চাটা এই গুটিকয় ‘বাংলাস্তানী’কে বাদ দিলে অন্য কাউকেই তো বাংলাদেশবিরোধী বলার সুযোগ নেই।
মুক্তিযোদ্ধাদের নিষ্কলুষ তালিকা প্রণয়ন অবশ্যই জরুরী, কারণ আগামীর বাংলাদেশকে চিনে রাখতে হবে দেশের সূর্য-সন্তানদের- যাদের জীবনবাজিতে মুক্ত স্বদেশ। একইভাবে তালিকাবদ্ধ করা প্রয়োজন শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর আর আলশামস বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের। যাদের বিরোধিতা ছিল বাংলাদেশের জন্মের প্রক্রিয়ায়। এই কুলাঙ্গারগুলোকে ডাস্টবিনে ছুড়ে দিলেইতো দাঁড়িয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বাঙালী আর লাল-সবুজের বাংলাদেশ। রাজাকারের তালিকা প্রণয়নে সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটি তাই বারে-বারে অভিনন্দনযোগ্য।
আরেকটি সাম্প্রতিক ঘটনাও একইভাবে আশাজাগানিয়া। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্সে প্রকাশ্য দিবালোকে লাখো পাকিস্তানী সোনার বাংলাদেশ-ভারত মিত্র বাহিনীর কাছে যে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ, সেই গৌরব মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন পরবর্তী সময়ে এদেশের বিমানবাহিনী প্রধান ও আরও পরে মাননীয় মন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) এ. কে. খন্দকার। পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের ছবিটি যতবার দেখেছি ততবারই পেছন থেকে উঁকি মেরে থাকা জনাব খন্দকারকে দেখে শ্রদ্ধাবনত হয়েছি। অথচ, তিনি ২০১৪’র আগস্টে তার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা ‘১৯৭১ ভেতরে বাইরে’ লিখে একদিনে নিজেকে আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে দিয়েছিলেন। কি, কেন, কিভাবে, কোন উদ্দেশ্যে ‘১৯৭১ ভেতরে বাইরে’-র ভেতরে বাইরে থেকে ঢুকিয়ে দেয়া ইতিহাস বিকৃতি তা ইতিহাসই নির্ধারণ করবে। জীবন সায়াহ্নে এসে খন্দকার সাহেব সত্যি কথাটা বললেন, ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গা থেকে সরিয়ে নেয়ায় তার দোষটুকু অন্ততঃ স্বীকার করলেন। আত্মসমর্পণের সেই ছবিতে এ. কে. খন্দকারকে দেখে ২০১৪’র আগস্টের পর থেকে আর কোনদিনও শ্রদ্ধা জাগেনি, ভবিষ্যতেও জাগবে না। না- তার এই প্রেস কনফারেন্সটির পরেও না। এখন ছবিটি দেখলেই মনে হয় বড্ড বেমানান ঐ উঁকি দিয়ে থাকা লোকটি ঐ ছবিতে। ভবিষ্যতেও তাই-ই মনে হবে।
জনাব খন্দকারের পথ ধরে আরও যারা ইতিহাসকে বিকৃত করে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন আশা করি তারাও তার দেখানো পথটাই ধরবেন। তা তারা না করলেও অবশ্য কিছুই এসে যায় না। কারণ, প্রজন্মের তাগিদে আর প্রজন্ম হিতৈষী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের আন্তরিকতায় ইতিহাস অবশেষে ইতিহাসের জায়গায় ফিরে আসতে শুরু করেছে। আশা করি, এখন জনাব খন্দকারের মতই আরও অনেকেই সত্যটা স্বীকার করে নিয়ে নিজেকে অন্তত আগামীর বাংলাদেশের কাছে ডাস্টবিনের বাসিন্দা হিসেবে দেখতে চাইবেন না।