খবর ৭১ঃ সংস্কার ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামীতে ভাঙনের সুর। মহান মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে দীর্ঘদিন ধরে অনেকেই দলের সংস্কার চাচ্ছেন। এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বহিষ্কারও হয়েছেন কেউ কেউ।
অনেকে আবার স্বেচ্ছায় দলত্যাগ করেছেন। সংস্কার চাওয়া এসব ব্যক্তি ও এই মতাদর্শের বিভিন্ন পেশাজীবীকে নিয়ে নতুন দল গঠন হতে যাচ্ছে।
আগামী ২৭ এপ্রিল জাতীয় প্রেস ক্লাবে দল গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হতে পারে। পরে দলের গঠনতন্ত্র, ইশতেহার চূড়ান্ত করে ৩ মাসের মধ্যে রাজনীতিতে সোচ্চার হওয়ার পরিকল্পনা তাদের। এ ক্ষেত্রে জামায়াত ত্যাগ করা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের ভূমিকা কী হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন দলের নাম এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে এ দলে যারা থাকছেন তারা সবাই বয়সে তরুণ ও শিবিরের সাবেক নেতা। মূলত একাত্তর-পরবর্তী প্রজন্মের লোকজনকে নিয়ে নতুন দল গঠন করা হচ্ছে। শিবিরের সাবেক সভাপতি ও জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত মজিবুর রহমান মঞ্জু দল গঠনে সমন্বয়কের ভূমিকায় রয়েছেন। ঠিক কারা এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত তা নিয়ে এখনই মুখ খুলতে চাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা।
সংস্কারপন্থীদের নতুন দল গঠন নিয়ে চাপ ও উদ্বেগে ফেলেছে জামায়াতের মূল নেতৃত্বকে। ইতিমধ্যে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সতর্ক করেছে শীর্ষ নেতৃত্ব। জানা গেছে, এ প্রক্রিয়ায় জড়িতদের পর্যবেক্ষণে রেখেছেন নীতিনির্ধারকরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। জানতে চাইলে মজিবুর রহমান মঞ্জু যুগান্তরকে বলেন, আমরা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি।
আগামী ২৭ এপ্রিল জাতীয় প্রেস ক্লাবে আনুষ্ঠানিকভাবে এ উদ্যোগের বিষয়ে ঘোষণা হতে পারে। সেখানে কেন আমরা রাজনৈতিক দল গঠন করব, কারা থাকবেন- এসব নিয়ে বিস্তারিত জানাব। এরপরই মূলত নতুন দলের নাম, গঠনতন্ত্র, ইশতেহার নিয়ে আমরা কাজ শুরু করব। তিনি বলেন, আমি নিজে যেহেতু শিবিরের সভাপতি ছিলাম সে হিসেবে শিবিরের অনেকেই এর সঙ্গে থাকতে পারেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এতে সম্পৃক্ত হবেন।
এ নিয়ে জামায়াতের কোনো নেতা বক্তব্য দিতে রাজি হননি। কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর অধ্যাপক মিয়া গোলাম পারওয়ারকে পাওয়া যায়নি। কথা বলতে রাজি হননি কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের। তবে দলের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, মজিবুর রহমান দল গঠন করলে তা জামায়াতের জন্য ভাবনার কারণ নেই।
খুব বেশি নেতাকর্মী তার সঙ্গে নেই। নতুন দল করলেও তারা খুব বেশি কিছু করতে পারবে না। রাজনীতির মাঠে এমন বহু দল রয়েছে নামসর্বস্ব। কিন্তু আবদুর রাজ্জাক সেই দলের নেতৃত্বে থাকলে জামায়াতের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। কারণ তৃণমূল জামায়াতের তরুণদের বড় অংশই তার সমর্থক।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) লন্ডনের ওসবর্নে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের আইন পেশার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘এন ইভিনিং উইথ ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক’ শিরোনামে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়।
সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমি নিজে কোনো দল করছি না। কিন্তু বাংলাদেশে একটি সুস্থ রাজনীতির ধারা গড়ে উঠুক- এটা আমি চাই। কেউ যদি এমন রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন, নাগরিক হিসেবে তাদের প্রতি আমার সমর্থন থাকবে। তবে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো পরিকল্পনা আমার নেই।’
জামায়াতে সংস্কার এবং একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইতে শীর্ষ নেতৃত্বকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়ে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালনকারী ব্যারিস্টার রাজ্জাক। কয়েক বছর ধরে তিনি লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে আছেন।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক জামায়াত বিলুপ্ত করে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য ক্ষমা চেয়ে নতুন দল গঠনের পরামর্শ দিয়েছিলেন দলের আমীর মকবুল আহমাদকে। রাজ্জাকের পদত্যাগের দিনই জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত হন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু। যিনি দলের মজলিশে শূরার সদস্য ছিলেন।
তিনিও একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চেয়ে উদারপন্থী দল গঠনের পক্ষে ছিলেন। জামায়াতের বুদ্ধিবৃত্তিক অংশের নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন মঞ্জু। অনেক নেতাকর্মী তার মতের সমর্থক মনে করা হলেও নতুন দলে আবদুর রাজ্জাক থাকবেন কি না, তা পরিষ্কার করেননি মঞ্জু। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমরা ব্যারিস্টার রাজ্জাককে ‘অ্যাপ্রোচ’ করিনি। তার কাছ থেকে আমরা পরামর্শ নিতে পারি। যেহেতু তিনি বিজ্ঞ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের সংস্কার চাওয়া ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক একজন সভাপতি যুগান্তরকে বলেন, জামায়াতে সংস্কার নিয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরেও ২০১০ সালে ভাঙনের ঘটনা ঘটে। সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের আগে তখন জামায়াতের প্রভাবশালী নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ কট্টরপন্থীরা ভেবেছিলেন যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে দলে সংস্কার নিয়ে শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়পন্থীরা একাট্টা। এ কারণে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তখনকার শিবিরের এক নেতাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র হওয়ার কারণে কেন্দ্রের সভাপতি হতে দেয়া হয়নি।
পরে এ নিয়ে শিবিরে ভাঙন দেখা দেয়, বড় একটি অংশ দল থেকে বেরিয়ে যায়। শিবিরের সাবেক এই সভাপতি বলেন, একাত্তর-পরবর্তী শিবিরের সাবেক সভাপতি, সেক্রেটারি জেনারেলসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা বেশিরভাগ নেতাই জামায়াতে ইসলামীর সংস্কারের পক্ষে। তবে এ নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস পান না। নতুন দল গঠনে মূলত তাদের ভূমিকাই বেশি। ইতিমধ্যে অধিকাংশ জেলায় তারা বৈঠকও করেছেন। আগামী ২৭ এপ্রিল নতুন দল গঠনের উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হলে জেলা নেতারাও (জামায়াতে সংস্কারের পক্ষে যারা) একাত্মতা প্রকাশ করবেন।
এদিকে সংস্কারপন্থীরা নতুন দল গঠনের উদ্যোগ নিলেও জামায়াতের নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া স্তিমিত হয়ে গেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে দলের তৃণমূল নেতাদের জন্য জারি করা নির্দেশনায় বলা হয়েছিল- মজলিশে শূরার পরামর্শে জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ নতুন নামে দল গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ৫ সদস্যের কমিটি করা হলেও নতুন দল গঠনে অগ্রগতি নেই বলে যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন জামায়াতের কর্মপরিষদের এক সদস্য। সূত্রটির দাবি, অতীতেও সংস্কারপন্থীদের চাপে কমিটি করা হয়েছিল।
তখনও কিছু করা হয়নি। এবারও কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে না। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করতেই ওই কৌশল। যদিও এখন আবারও সংস্কারপন্থীদের নতুন উদ্যোগের ফলে দল ভাঙার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় নানা কৌশলে এগোচ্ছে যুদ্ধাপরাধীর দায়ে অভিযুক্ত দলটি। সংস্থারপন্থীদের ওপর নজর রয়েছে। দলের পদে থেকে এমন তৎপরতার সঙ্গে কারও যুক্ত হওয়ার প্রমাণ পেলে বহিষ্কার করবে দলটির মূল নেতৃত্ব।
জামায়াতে সংস্কার নিয়ে ১৯৭৯ সাল থেকেই বিরোধ চলছে। ১৯৭৭ সালে ধর্মভিত্তিক দল গঠনে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর জামায়াত নেতারা মাওলানা আবদুর রহিমের নেতৃত্বে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) গঠন করেন। স্বাধীনতা বিরোধিতাকারীদের অন্যতম নেতা গোলাম আযম দেশে ফিরে ১৯৭৯ সালে জামায়াত পুনরুজ্জীবিত করেন।
দলচ্যুত হন সংস্কারের দাবি করা আবদুর রহিম। সংস্কারের দাবিতে ১৯৮১ সালে জামায়াত-শিবিরে ফের অস্থিরতা দেখা দেয়। তখন যারা সংস্কারের দাবি করেছিলেন তাদের দলছাড়া করা হয়। ২০০৭ সালে ফের জামায়াতে সংস্কারের দাবি ওঠে। ২০১০ সালে কামারুজ্জামান, আবদুর রাজ্জাক ও মীর কাসেম আলী সংস্কারের প্রস্তাব করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তখনও সংস্কারের জন্য কমিটি হয়। তবে মতিউর রহমান নিজামীসহ রক্ষণশীল নেতাদের বিরোধিতায় সে উদ্যোগ ভেস্তে যায়। একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা না চাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে জামায়াত। এখনও অনড়।