বায়ু দূষণ রোধে কেবল প্রকল্প নয়, বাস্তবায়নে নজরদারী চাইঃ পবা

0
479

খবর ৭১ঃ
বায়ুদূষণের চিহ্নিত উৎস সমূহ নিয়ন্ত্রণের জন্য লক্ষ্যমাত্র স্থির, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য অংশীজনের সাথে নিয়ে রোডম্যাপ তৈরি করে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাওয়ার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন পবা আয়োজিত গোল টেবিল বৈঠকের আলোচকরা।
বায়ু দূষণে হুমকীতে জনস্বাস্থ্য, দূষণ নিয়ন্ত্রণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বনাম প্রকল্প ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তরারা বলনে, বায়ু দূষণের অচিহ্নিত উৎসসমূহ চিহ্ণিত ও তা নিয়ন্ত্রণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ অধিক জরুরি। এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে বরাদ্দের মাধ্যমে হোক।
রাজধানীর কলাবাগানে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবা’র কার্যালয়ে আজ (৮ এপ্রিল সোমবার) অনুষ্ঠিত এ গোল টেবিল বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান। ফেরদৌস আহমেদ উজ্জলের সঞ্চালনায় এতে আলোচনা করেন পবা’র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আব্দুস সোবহান, পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা: লেলিন চৌধুরী, নাসফের সাধারণ সম্পাদক মো: তৈয়ব আলী, ক্যাব নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ, মো: সেলিম প্রমূখ।
গোল টেবিল বৈঠকে বক্তরা জানান,বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন বলা হয় বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে বলা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে গত বছর ১৯৭ দিন রাজধানীবাসী দূষিত বাতাসে ডুবেছিল। আগের বছরগুলোতে রাজধানীর বাতাস বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১২০ থেকে ১৬০ দিন দূষিত থাকত। অর্থাৎ ঢাকার বায়ুদূষণ সময়ের বিবেচনায়ও বিপজ্জনক হারে বাড়ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, রাজধানীর বাতাসে দ্রুত দূষণকারী পদার্থ ছড়িয়ে পড়ছে অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজের কারণে। আর দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই সরকারি ।
পরিবেশ রক্ষার জন্য সরকারের একটি বিশেষ সংস্থা পরিবেশ অধিদপ্তর রয়েছে, যার লোকবলের সংখ্যা ৪৬৫ জন। সারা দেশের ২১ টি জেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের অফিস রয়েছে। এই সংস্থাটি মহাপরিচালকের নেতৃত্বে পরিবেশ সংরক্ষন আইন ১৯৯৫ অনুসারে পরিচালিত। এছাড়া পরিবেশ রক্ষার জন্য সরকার পরিবেশ আদালত আইন প্রণয়ন করেছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও পরিবেশ আদালত আইন অনুসারে মহাপরিচালকে আদালতে সরাসরি মামলা দায়ের করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। পরিবেশ অধিপ্তরের তথ্য অনুসারে ২০০৯-২০১৭ সাল পর্যন্ত উচ্চ আদালতে পরিবেশ সংক্রান্ত রিট হয়েছে ৯৩৯টি। এছাড়া পরিবেশ আদালত আইন, ২০১০ পাস হওয়ার পর গত নয় বছরে ঢাকা পরিবেশ আদালতে মামলা হয়েছে ১৭২টি। পরিবেশ সংক্রান্ত হাতেগোনা যে কয়টি মামলা এ আদালতে দায়ের হয়েছে, সাক্ষী উপস্থিত না হওয়াসহ নানা কারণে তাও ঠিকমতো নিষ্পত্তি হচ্ছে না। ১৭২টি মামলার মধ্যে এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৮২টি। এ আদালতে ২০১০ সালে পরিবেশবিষয়ক মামলা হয়েছে ৬০টি। ২০১১ সালে ৩৩টি, ২০১২ সালে ২৪ টি, ২০১৩ সালে নয়টি, ২০১৪ সালে নয়টি ও ২০১৫ সালে আটটি মামলা হয়। এছাড়া ২০১৬ সালে চারটি ও ২০১৭ সালে ছয়টি মামলা হয়েছে এ আদালতে ।

পরিবেশ অধিদপ্তর ইটভাটার দুষণ নিয়ন্ত্রণ কাজ করে যাচ্ছে, এ সংস্থার তথ্য অনুসারে সাথে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত বিদ্যমান ইটভাটার ৬৫.৫৮% আধূনিক প্রযুক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব হয়েছে। এ হিসেবে বায়ু দূষণ কমে যাবার কথা। এছাড়া বায়ু দূষণ রোধে সংস্থাটি ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন, ইটভাটায় ১১৬টি মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়েছে। ২৭৯টি ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। জরিমানা আদায় হয় দুই কোটি টাকা। যানবাহনের বিরুদ্ধে ৩৫টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। ১১৯টি যানবাহনের বিরুদ্ধে ৩,২০,৭০০টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
বায়ু দূষণের বর্তমান অবস্থার পাশাপাশি পরিবেশ অধিপ্তরের কার্যক্রম বিবেচনা করলে তা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় পরিবেশ অধিদপ্তর বায়ু দুষণ রোধে কার্যক্রম পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। ব্যক্তিগত গাড়ী বৃদ্ধি বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। ব্যক্তিগত গাড়ির দূষণ এবং নির্মাণ কাজের দূষণ হ্রাসে এ সংস্থা কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে এ নগর আজ দূষণের নগরীতে পরিণত হয়েছে। নির্মল বায়ু ও টেকসই উন্নয়ণ প্রকল্পের আওতায় পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এবং ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কোর্ডিনেশন অর্থরিটি কাজ করছে। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে পরিবেশ অধিদপ্তরে এ প্রকল্পের বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৭৮১৫.০০ (লক্ষ টাকায়) টাকা। বিশাল অর্থের বাজেট, লোকবল এবং বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে কার্যক্রম থাকলেও বায়ু দূষণ রোধ কেন ব্যর্থ হচ্ছে তা খুজে বের করা প্রয়োজন। পরিবেশ অধিদপ্তর আইনের প্রয়োগ ও মনিটরিং অপেক্ষা অন্যান্য কাজে লোকবল ও বিনিয়োগ করার কারণে দেশের পরিবেশ দিন দিন ধ্বংস হচ্ছে।
ঢাকায় মহামারীর বায়ু আকারে দূষণের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বায়ু দূষণের প্রধান প্রধান উৎসগুলো চিহ্নিত করে, সেগুলির উৎস কমানো বা বন্ধ করার ফলপ্রসু উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। যেমন- বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ নিম্নমানের কয়লা বা তেলের ব্যবহার। পরিবেশ অধিদপ্তরের মান অনুসারে উচ্চ সালফারযুক্ত কয়লা আমদানি নিষিদ্ধ। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি সার্কুলারের মাধ্যমে পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্ধারিত মান অকার্যকর করেছে। যার ফলে নিম্ন মানের উচ্চ সালফারযুক্ত আমদানিকৃত কয়লা, ইটের ভাটাসহ অন্যান্য জায়গাতেও ব্যবহার হচ্ছে। এজন্য শুষ্ক মৌসুমে ইটের ভাটা চালু থাকার সময় বায়ু দূষণ অনেক বেড়ে যায়। বায়ুতে সালফারের মাত্রা কামাতে হলে নিম্ন মানের কয়লা আমদানি বন্ধের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের সার্কুলারটি আদালতের মাধ্যমে অকার্যকর করতে হবে অথবা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সার্কুলারটি মানতে বাধ্য করা বা অনুরোধ করতে হবে। এ জন্য বিশেষ কোনো প্রকল্প বা অর্থের প্রয়োজন নাই। নিম্ন মানের ডিজেল বা পেট্রোল রিফাইন বা আমদানি বন্ধের জন্য জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের সহায়তা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রেও পরিবেশ অধিদপ্তরের আলাদা কোন প্রকল্পের প্রয়োজন নাই। ইটভাটার নিম্ন টেকনোলজির ব্যবহার রোধে সংশিষ্ট অধিদপ্তরের আইনগত ক্ষমতা প্রয়োগ প্রয়োজন। এখানে পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রকল্পের প্রয়োজন নাই। মোটর যানের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে বিআরটিএ বা পুলিশের সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন।
বায়ু দূষণের অন্যতম উপাদান ধুলা দূষণ। সেখানেও ধুলা দূষণের উৎসসমূহ চিহ্নিত করে সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষকে (ডিএসসিসি, ডিএনসিসি, ওয়াসা, রাজউক ইত্যাদি) উদ্বুদ্ধ বা বাধ্য করতে হবে। এখানে প্রয়োজন মন্ত্রণালয়ের সহায়তা। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ু বা ধুলা দূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রকল্পের প্রয়োজন নাই। প্রয়োজন ধৈর্যসহকারে উদ্যোগ গ্রহণ করা। প্রয়োজনীয় অর্থের যোগানের জন্য বিশেষ বাজেটে বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন।
সরকার ইতোমধ্যে এপিএ (বার্ষিক মূল্যায়ন চুক্তি) করেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে লক্ষ্যমাত্রা সুনির্দিষ্ট করা ও তা অর্জনের বিষয়টি বার্ষিক চুক্তিতে উল্লেখ করা ও তা জনসম্মূখে প্রকাশ করা প্রয়োজন। এ বিষয়গুলি জনসম্মুখে প্রকাশ করলে অধিদপ্তরের কাজের মূল্যায়ন করা সহজ হবে। যেমন বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণসহ অন্যান্য দূষণের মাত্রা কমানোর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ও তা বাস্তবায়নের রোড ম্যাপ তৈরি করে কাজ করা ও তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা। এছাড়া ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে কাজের অগ্রগতি ও তার মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ প্রয়োজন। এভাবে কাজ করলে পরিবেশ আইন বাস্তবায়নে সমাজের বিভিন্ন মহল ও জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে পরিবেশ অধিদপ্তরকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসবে। পরিবেশ আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে আমরা একটি বাসযোগ্য মহানগর ও দেশ পাবো

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here