খবর ৭১ঃ সামান্য ভুলের কারণে বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি প্রকল্পে সরকারকে গচ্চা দিতে হয়েছে ৩০০ কোটি টাকা! ক্ষতি হয়েছে শত শত বিঘা কৃষি জমির। হাজারও কৃষক হয়েছেন ভূমিহীন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনটি ২০১৭ সালের জুনে দেয়া হয়। তখন প্রকল্পের বয়স ছিল সাত বছর। ২০১০ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০১৫-তে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালেও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের দাবি, চলতি বছরের জুনে এর কাজ শেষ হবে।
প্রকল্পটির নাম ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ’। এটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৯৮২ কোটি ৮৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। ২০১৩ সালে প্রথম সংশোধনীতেই ব্যয় বাড়ানো হয় ৪৫৩ কোটি ১৬ লাখ ১০ হাজার টাকা। প্রায় ৪৬ শতাংশ ব্যয় বাড়ানোর পর প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়ায় এক হাজার ৪৩৬ কোটি দুই লাখ ৬৭ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে এসে দ্বিতীয় সংশোধনীতে প্রকল্পের সময় বাড়ানো হলেও মেয়াদ বাড়ানো হয়নি বলে জানান প্রকল্প পরিচালক মো. আসাদুল হক।
প্রকল্পের রুট ম্যাপ পর্যালোচনা করে আইএমইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রকল্পের প্রাথমিক লক্ষ্যই হচ্ছে সরাসরি ও ন্যূনতম দূরত্বে গন্তব্যে পৌঁছানো। এই প্রকল্পে ঈশ্বরদী-মাঝগ্রাম-পাবনা-তাঁতীবান্ধা-কাশীনাথপুর-ঢালারচর বরাবর রেললাইন নির্মাণ হচ্ছে। এর পরিবর্তে ঈশ্বরদী-মাঝগ্রাম-পাবনা-তাঁতীবান্ধা-ঢালারচর সরাসরি রেললাইন নির্মাণ করলে ১৪ কিলোমিটার রেললাইন কম নির্মাণ করতে হতো। এতে সরকারকে ৩০০ কোটি টাকা কম খরচ করতে হতো। সেই সঙ্গে রক্ষা পেত শত শত বিঘা কৃষি জমি।’
দূরত্ব কমানোর বিষয়টি পুনরায় পরীক্ষা করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলা হয় ওই প্রতিবেদনে। তবে দূরত্ব না কমিয়ে আগের রুটেই রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে বলে জানান প্রকল্পের পরিচালক আসাদুল হক।
ওই প্রকল্পের সার্ভে, ডিজাইন প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত কনসালট্যান্টের (পরামর্শক) ‘ভুলের কারণে’ ওই ঘটনা ঘটেছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তাতে বলা হয়, ‘কনসালট্যান্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। তবে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি-না, তা জানেন না প্রকল্প পরিচালক।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘একইভাবে মাঝগ্রাম স্টেশন ইয়ার্ড থেকে পাবনা অভিমুখী রেল ট্র্যাকের সংযোগের জন্য নিয়োজিত কনসালট্যান্ট চাহিদামাফিক ড্রইং ও টেন্ডার ডকুমেন্টস না দেয়ায় নির্ধারিত সময়কালের তিন বছর অধিককাল আলোচ্য প্রকল্প বিলম্বিত হচ্ছে এবং তা হয়েছে একমাত্র কনসালট্যান্টের ভুলের কারণেই।’
কনসালট্যান্টের আরও অনিয়ম তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রকল্প সার্ভে, ডিজাইন, নকশা, দরপত্র দলিল, স্পেসিফিকেশন তৈরির কাজে নিয়োজিত কনসালট্যান্ট প্রাথমিক প্রস্তাবে মাঝগ্রাম বিদ্যমান রেলস্টেশনে ‘ডুয়েল গেজ’ রেলট্র্যাক থাকা সত্ত্বেও প্রকল্পের জন্য ডুয়েল গেজের পরিবর্তে কেন ব্রডগেজ সংযোগ প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছিল তা গুরুত্বের সঙ্গে যথাযথ তদন্তের জন্য মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। উল্লেখ্য, এ কারণে প্রকল্প নির্মাণকাল তিন বছর বিলম্বিত হয়েছে এবং ঠিকাদারকে ভেরিয়েশন অর্ডারের মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা দিতে হচ্ছে।’
২০১৭ সালের জুনে ওই প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় আইএমইডির পরামর্শক ছিলেন মো. রফিকুল আলম। তিনি জানান, তিন-চার মাসের জন্য ওই সময় পরামর্শক ছিলেন। এখন তার বক্তব্য, ‘দুই বছর আগের ঘটনা তো, সেটা এখন মনে নাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওই প্রকল্প তো ২০১৭ সালেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখন এর ভেতরে সমস্যা কী, সেটা তো আমার জানা নাই।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কাজী মো. রফিকুল আলমের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন আইএমইডির তখনকার ওই পরামর্শক। এ প্রকল্পের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিও রেলওয়ের মহাপরিচালক।
প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে অনিয়ম
আইএমইডি’র ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘প্রকল্প শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ন্যূনতম চারজন প্রকল্প পরিচালক এবং তিনজন টিম লিডার (কনসালট্যান্ট) প্রকল্পের কাজে কর্মরত ছিলেন বা আছেন। যদিও ২০১৬ সালের ১২ মে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক অনুশাসনে প্রকল্পের জন্য স্বতন্ত্র প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের সিদ্ধান্ত দেন। এছাড়া প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ-সংক্রান্ত নির্দেশিকায় ৫০ কোটি বা তার ঊর্ধ্বের প্রকল্পের জন্য স্বতন্ত্র প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয়ার কথা। কিন্তু এখানে সেটা মানা হয়নি।’
বরং অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে দুই ধাপ নিচের কর্মকর্তারা প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন এবং তাতে ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) ব্যত্যয় হয়েছে এবং আর্থিক শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ হচ্ছে বলেও জানায় ওই প্রতিবেদনে।
ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক এবং কনসালট্যান্টের টিম লিডার পরিবর্তন হওয়ায় কাজের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি এবং প্রকল্প ব্যয় বাড়ছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা
২০১৭ সালের জুনে ওই প্রতিবেদন দেয়ার পর প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পান মো. আসাদুল হক।
তিনি বলেন, ‘ওই প্রকল্পের বর্তমান অগ্রগতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই জুনের মধ্যে শেষ হবে। প্রকল্পে এখন কোনো সমস্যা নাই।’
‘প্রকল্পের বর্তমান বাস্তব অগ্রগতি ৯৭ শতাংশ। তবে আর্থিক অগ্রগতি এ মুহূর্তে মনে নাই’- যোগ করেন আসাদুল হক।
দোষীদের শাস্তির দাবি টিআইবির
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আইএমইডির ভূমিকা হচ্ছে, দেশের সব প্রকল্প পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন করে তাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে অনুসন্ধান-সাপেক্ষে যথাযথ প্রক্রিয়ায় সুপারিশ করা। আইএমইডি যে সুপারিশ বা নির্দেশনা দিক না কেন, সেটা ওই সংস্থার জন্য পালন করা বাধ্যতামূলক। ওই প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেটা অবমাননা করা হয়েছে, কোনো গুরুত্ব দেয়া হয়নি, তোয়াক্কা করা হয়নি।’
এর ক্ষতিকারক দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এতে বহুমুখী ক্ষতি হলো। জনগণের ৩০০ কোটি টাকার অপচয় হলো। এতে যে শুধু অর্থের অপচয় হলো তা নয়, চিরদিনের জন্য রেলপথের দূরত্বও বেড়ে গেল। এর প্রভাব পড়বে যাতায়াত খরচ এবং রেল পরিচালনার ওপর।’
‘এগুলো অনুসন্ধানের প্রয়োজন। আমাদের দেশে এসব ক্ষেত্রে এমন প্রবণতা আছে যে, কোনো বিশেষ মহলের ভূমি বা বাড়িঘরকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে রেললাইন বাঁকা করা হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর’- যোগ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।
আইএমইডির সুপারিশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নেয়নি উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘কনসালট্যান্টের দোষ থাকতেই পারে, তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো, কনসালট্যান্ট তার কাজ শেষ করেছে, আইএমইডি তারপর সমস্যাটা চিহ্নিত করেছে। তখন প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলছিল। তখন হয়তো এটা সংশোধনের সুযোগ ছিল। আইএমইডি যেহেতু সুপারিশ করেছিল, কিন্তু সেই সুযোগটা তো রেল কর্তৃপক্ষ নিল না। ওই প্রকল্পে বেশকিছু অনিয়ম হয়েছে, যেগুলো চিহ্নিত।’
কোনো বিশেষ মহলের সুবিধার্থে প্রকল্পের বহুমুখী ক্ষতি করা হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, ‘ওই প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও অমান্য করা হয়েছে। কেউ তো আর বিচারের ঊর্ধ্বে নয়। যারা এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে এ ধরনের অনিয়ম চলতেই থাকবে।’